ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ৫ মে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তৃতা রাখেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এখানে তিনি মধুপুর শালবন নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, শালবনের ১৫০ একর জমিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ বাদ দিয়ে শালবন লাগানো হবে।
মধুপুর শালবনটি মধুপুর গড় নামে পরিচিত। এর আয়তন ৪ হাজার ২৪৪ বর্গ কি.মি.। মধুপুর গড়ের প্রধান গাছ হলো শাল। এই কারণে একে শালবনও বলা হয়। একে ঝরাপাতার বনও বলা হয়। কারণ শীতকাল শেষ হলে শাল গাছের পাতা ঝরে যায়। পাতা পচে সার হয়। সেই সারের পুষ্টি পেয়ে আবার নতুন গাছ হয়। এটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যানও বটে। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় এর অবস্থান। একে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয় ১৯৬২ সালে। মধুপুর অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবেও পরিচিত। মধুপুর গড় পুরোটাই বন দিয়ে বিস্তৃত ছিল ৫০ বছর আগেই। কিন্তু গাছ কাটার ফলে এখন বনভূমি হয়েছে মাত্র ৬০০ বর্গ কিলোমিটারের। বনায়ন করা হলেও শাল না লাগিয়ে লাগানো হচ্ছে আকাশি আর ইউক্যালিপটাস গাছ। এর ফলে কমে যাচ্ছে পাখি প্রজাতি।
মধুপুর জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের বৃহত্তম শালবন। এছাড়া একটি তথ্য মতে গত ৩০ বছরে মধুপুর শালবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ঢাকা সম্প্রসারণের কারণে। নগরায়ণের বড় প্রভাব পড়েছে এতে।
এলিয়েন স্পেসিস হলো একটি বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশকারী নতুন প্রজাতি। স্থানীয় বিভিন্ন প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে এসব এলিয়েন স্পেসিসের কারণে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোনও প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি হলো সেই এলাকায় এলিয়েন স্পেসিস বা প্রজাতির প্রবেশ। যেসব প্রজাতি ভিন্ন বা নতুন বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশ করে স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাদের আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস বলে। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন বাংলাদেশে এসব গাছ এলিয়েন স্পেসিস হিসেবে গণ্য।
ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন এসব বিদেশি গাছ প্রবেশ করে বাংলাদেশে আশির দশকে। এসব গাছের চারা বিনামূল্যেও বিতরণ করা হতো সে সময়। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এর চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করে।
আমাদের দেশে ইউক্যালিপটাস জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এটি দ্রুত বাড়ে। খুব একটা যত্ন করতে হয় না। চারা রোপণ করলে গরু-ছাগল এসবের পাতা খায় না। চাষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এসব গাছ মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি ও পানি শোষণ করে। ফলে এর আশপাশের স্থানীয় জাতের গাছ এদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। দেখা গেছে এই ধরনের গাছের নিচে ঘাস বা অন্য কোনও লতা জাতীয় গাছ থাকে না। মাটিও বেশ শুষ্ক থাকে। এই ধরনের বিদেশি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় জ্বালানিতে অবদান রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি গাছের সাথে দেশি গাছ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এমনকি এদের বংশবৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। উপকারী কীটপতঙ্গ মারা পড়ে। তবে এর ফলে একটা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় দেখা যায় যে এতে কোনও পাখি বাসা বাঁধে না। এমনকি এর নিচে যেমন বিশ্রাম নেওয়া যায় না, তেমনি এর কাণ্ড পাতায় কোনও অণুজীবও জন্মায় না।
একটি গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ইউক্যালিপটাস লাগানোর ফলে মাটির ঊর্বরতা ১৫ শতাংশ কমে যায়। এরা মাটির পানি দ্রুত শুষে নেয়। বাষ্পীভবনের হার বেশি হয়। আমাদের দেশের ৯২ ভাগ মানুষ এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত নয়। একটি তথ্য মতে ইথিওপিয়ায় ভুট্টাক্ষেতের পাশে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪.৯ থেকে ১৩.৫ টন হ্রাস পায়।
পাকিস্তানের একটি গ্রামে ১৯৯৫ সালে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো হয়। ২০০০ সালে সেই গ্রামের পানির স্তর ২ ইঞ্চি কমে যায়। ইউক্যালিপটাসের ক্ষতি বুঝতে পেরে কেনিয়ায় এর রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইউক্যালিপটাস, আকাশমনির মতো বাংলাদেশে এলিয়েন প্রজাতি হিসেবে আরও রয়েছে কচুরিপানা, পার্থেনিয়াম, লজ্জাবতী, আসামলতা, স্বর্ণলতা, ঢোলকলমি। বাংলাদেশে এরকম ১৫টি আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস শনাক্ত করেছে ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান। ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যানে এলিয়েন স্পেসিসকে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস এসব নানা জাতের বিদেশি গাছের আশ্রয় এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বুল প্রভৃতি গাছ প্রবেশ করে ব্রিটিশ আমলে। আকাশমণি, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা, ইউক্যালিপটাস, খয়ের জাতীয় গাছ প্রবেশ করে আশির দশকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে কচুরিপানা, পার্থোনিয়াম, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, রিফুজিলতা ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞদের মতে এসব বিদেশি গাছের কারণে বাংলাদেশে ৫ হাজার প্রজাতির দেশি গাছ থাকলেও এটি এখন কমে ৩ হাজার ৮২৮ প্রজাতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকার শালবনে ইউক্যালিপটাসের বদলে শাল গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। সরকার এরকম আরও যেসব প্রজাতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেসব উদ্ভিদ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে স্থানীয় প্রজাতির টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। হয়তো এই ধরনের উদ্যোগ নিলে বিলুপ্ত অনেক প্রজাতির আবার দেখাও মিলতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।