X
মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিনিয়োগবান্ধব আমলাতন্ত্র কেন জরুরি?

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান
২০ মে ২০২৫, ১৯:৪০আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ১৯:৪০

বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ধরে রাখার সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, কর প্রণোদনা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ হলেও একটি প্রায়শই উপেক্ষিত অথচ মৌলিক উপাদান হলো প্রশাসনিক কাঠামো এবং এর দৃষ্টিভঙ্গি।

একটি দক্ষ, বিনিয়োগ সহায়ক এবং জবাবদিহিমূলক সিভিল সার্ভিস অর্থনৈতিক রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে, একটি অনমনীয়, জটিল এবং সেবাবিমুখ আমলাতন্ত্র সবচেয়ে আধুনিক বিনিয়োগ নীতিমালাকেও ব্যর্থ করে দিতে পারে। বাংলাদেশে এখনও প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে ঔপনিবেশিক আমলের নিয়ন্ত্রণ ও আনুগত্যের প্রবণতা দৃশ্যমান, যেখানে সেবাপ্রদান ও সহায়তার বদলে বিধিনিষেধ আরোপে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অতএব, আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

বিগত কয়েক বছরের বিনিয়োগ চিত্র খুব একটা সুখকর নয়। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ৮.৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের ১.৬১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১৪২ মিলিয়ন ডলার কম। এই পতনের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাবিনিময় হারের অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রধানত দায়ী থাকলেও, বিনিয়োগবান্ধব আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাও প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।  

বিনিয়োগকারীরা—হোক তারা দেশীয় উদ্যোক্তা কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা—বিশ্বাসযোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেন। অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত প্রশাসনিক জটিলতা, দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকগণ ধারণা করেন, একটি বৃহৎ শিল্প প্রকল্পের অনুমোদন পেতে ৬-৯ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় এবং একটি কারখানা স্থাপনে প্রায় ৩০টির বেশি অনুমোদন প্রয়োজন, যার অধিকাংশই ডিজিটালভাবে সমন্বিত নয়। ভূমি বরাদ্দ, পরিবেশগত ছাড়পত্র, কর নিবন্ধন এবং বিদ্যুৎ-জল সরবরাহের ক্ষেত্রে বিলম্বও একটি নিয়মিত সমস্যা।  

এই প্রক্রিয়াগত জটিলতাগুলোর পেছনে রয়েছে একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যা, যা সমসাময়িক বিনিয়োগ চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

কৌশলগত কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করার আগে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোর্ড (EDB) মডেল উল্লেখযোগ্য।

পেশাদারিত্ব, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতার জন্য দেশটির সিভিল সার্ভিস বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এখানে বিনিয়োগ সহায়তা প্রদানের জন্য একটি একক সংস্থা গঠিত হয়েছে, যেখানে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ট্রেড, প্রযুক্তি, অর্থ ও আইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেনারেলিস্ট পরীক্ষার বদলে ক্ষেত্রভিত্তিক দক্ষতা বিবেচনা করা হয়। সিঙ্গাপুর বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের  মাধ্যমে বিনিয়োগ অনুমোদন প্রক্রিয়াকে স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।

রুয়ান্ডা একটি নিম্ন আয়ের দেশ হয়েও আফ্রিকার বিনিয়োগবান্ধব দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে ‘রুয়ান্ডা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ (RDB) নামক একক সংস্থা সব ধরনের বিনিয়োগ অনুমোদন প্রদান করে থাকে। কর্মকর্তারা নির্ধারিত কর্ম সম্পাদন সূচক অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। এখানে ইলেকট্রনিক পোর্টালের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা অনুমোদনের অগ্রগতি রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। পাশাপাশি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘Customer Happiness Centres’-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়।

বাস্তবতা বিবেচনায় এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।  প্রথমেই কাঠামোগত সংস্কার করা জরুরি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কাঠামোর আওতায় ফাইন্যান্স, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ডিজিটাল অর্থনীতি ও শিল্পনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ/অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে  “বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্লাস্টার” গঠন করা যেতে পারে। সেই সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট  মধ্য ও উচ্চ পর্যায়ের পদে কর্ম সম্পাদন সূচক (KPI)-ভিত্তিক নিয়োগ কার্যকর করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, শিল্প, বিদ্যুৎ, ভূমি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে “দ্রুত-বিনিয়োগ সেবা ইউনিট (Fast-track Investment Service Unit)” প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।  

এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত সংস্কারও করতে হবে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA)-এর নির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি।  সেই সাথে ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট সিঙ্গেল উইন্ডো (NISW)’ প্ল্যাটফর্ম চালু করে সব অনুমোদন প্রক্রিয়াকে একটি প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করা সময়ের দাবি। বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সেবার মান সম্পর্কিত চুক্তি (SLA) স্বাক্ষর ও এর ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বার্ষিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কোনও বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে  BIDA-এর আওতায় একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ইউনিট গঠন করতে হবে, যা নিয়মিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এর পাশাপাশি, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় ক্ষমতায়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকদের অধীনে ‘জেলা বিনিয়োগ সহায়তা সেল (DIFC)’ গঠন করে স্থানীয় পর্যায়ে বিনিয়োগ অনুমোদনের ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে। তবে এই ইউনিটগুলোকে ইউটিলিটি, ব্যাংক এবং ভূমি অফিসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

সর্বোপরি,  সেবাভিত্তিক সাংস্কৃতিক রূপান্তর জরুরি। এ লক্ষ্যে “বিনিয়োগের জন্য  সিভিল সার্ভিস” শীর্ষক সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে জর্জিয়ার ‘Produce in Georgia’  মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে, যেখানে কর্মকর্তারা প্রশাসনের পাশাপাশি বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং  বিপণনের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেই সঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সংলাপের জন্য জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে ডায়ালগ প্ল্যাটফর্ম গঠন করা প্রয়োজন।

এই রূপান্তরমূলক যাত্রায় অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত, আমলাদের প্রতিরোধ, প্রতিষ্ঠানগত দ্বন্দ্বসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকবে। এসব বাধা অতিক্রম করতে হবে একটি সমন্বিত ‘whole-of-government’ দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ক্রমাগত অংশীজন পরামর্শের মাধ্যমে।

মূল কথা হলো, বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসকে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো থেকে বিনিয়োগ সহায়ক, সেবামূলক ও উদ্ভাবন-উপযোগী কাঠামোতে রূপান্তরিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল প্রযুক্তিকরণ বা নীতিমালা পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; মূল কাঠামো, প্রণোদনা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে  সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন করাই হবে ২১শতকের বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য মূল চালিকাশক্তি। এই যাত্রা ধাপে ধাপে নয়, বরং রূপান্তরমূলক হওয়া উচিত। একটি  দক্ষ এবং বিনিয়োগকেন্দ্রিক সিভিল সার্ভিসই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য টেকসই সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

লেখক:  জনপ্রশাসন ও জননীতি বিশ্লেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে বুধবার এনসিপির বিক্ষোভ
ইসি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে বুধবার এনসিপির বিক্ষোভ
‘জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন রৌমারীর ইউএনও’
‘জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন রৌমারীর ইউএনও’
যুদ্ধবিরতির নামে সময়ক্ষেপণ করছে রাশিয়া: জেলেনস্কি
যুদ্ধবিরতির নামে সময়ক্ষেপণ করছে রাশিয়া: জেলেনস্কি
ছাত্রদলের অবরোধ শেষে শাহবাগে যান চলাচল স্বাভাবিক
ছাত্রদলের অবরোধ শেষে শাহবাগে যান চলাচল স্বাভাবিক
সর্বশেষসর্বাধিক