চাকরিতে প্রবেশ সীমা ৩৫ দাবি: মানবিক নাকি যৌক্তিক?

বেশ কয়েক বছর ধরেই চাকরির প্রবেশ সীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা ধারাবাহিকভাবে দাবি আদায়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে। সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের একজনকে তার শিক্ষা জীবনের অর্জিত সকল সনদ পুড়িয়েও আন্দোলন করতে দেখা গেছে। প্রতীকী আন্দোলনের অংশ হিসেবে কেউ কেউ অনলাইন-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসেও সনদ পানিতে ধুয়ে পানি খেয়েও অভিনব প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছেন। তারা বারবার চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাবি আদায়ের। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন শাহবাগ ও প্রেসক্লাবেও।

তাদের দাবির সাথে বিভিন্ন সময় একাত্মতা পোষণ করেছেন কয়েকজন সংসদ সদস্যও। এক সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদও চাকরির প্রবেশ সীমার বয়স ৩৫ করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় বরং বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও বিষয়টি যৌক্তিক মনে করে ২০১৮ সালে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে বিষয়টি যুক্ত করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তাদের দাবি-দাওয়া উপেক্ষিত হয়ে আসছে।

সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের দাবি, প্রতিযোগিতার এই সময়ে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিতে ৩০ পেরিয়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের কারণে বয়সসীমা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসে। এতে করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এতে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

এছাড়া করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেশনজট বৃদ্ধিতে এই হতাশা বেড়েছে কয়েকগুণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই দাবিটি কি মানবিক কারণেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত নাকি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দাবিটি আসলেই যৌক্তিক।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই দাবি বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কোথাও ৩৫, কোথাও ৪০, আবার কোথাও কোথাও বয়সের কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৪০ বছর, আফগানিস্তানের ৩৫ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, নেপাল ৩৫ বছর, ভুটান ৩৫, ভারত ৩৫/৪০ (রাজ্যভেদে)। কিছু দেশে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের কোনও সীমাবদ্ধতাই নেই, যোগ্যতা থাকলেই যে কোনও সময় চাকরিতে আবেদন করা যায়।

শুধুমাত্র ৩০-এর বিধান রয়েছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে। শুধু তাই নয় আমরা যাদেরকে অনুসরণ করে উন্নত বিশ্বের অংশীদার হতে স্লোগান দেই বা টকশো কাঁপিয়ে উদাহরণ টানি সেসব ইউরোপ আমেরিকার দেশের সরকারি চাকরির প্রবেশ সীমা আরও বেশি। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সরকারি চাকরি বয়সসীমা ৫৯ বছর।

মজার ব্যাপার হলো, আমরা যাদের কথায় কথায় শত্রু বলে আখ্যায়িত করি এবং ঐতিহাসিকভাবে যারা আমাদের দেশের মানুষের মনে ক্ষোভের রেখা এঁকে রেখেছে সেই পাকিস্তানের বয়সসীমার সাথেই কেবল আমাদের মিল রয়েছে। যে দেশটি আমাদেরকে ২৪ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি করে রেখেছিল, যে দেশটি ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে, যে দেশটি এখনও ভঙ্গুর রাষ্ট্রের তালিকা থেকেই বেরোতে পারেনি, আমরা কিনা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার নীতিমালায় সে-ই পাকিস্তানকেই অনুসরণ করছি। এই নীতিমালা স্বাভাবিকভাবেই ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। যা অত্যন্ত দু্ঃখজনক।

এছাড়াও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করলে দেখা যায়, যে সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ ছিল, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪০ বছর। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ এ উন্নীত করা হয়, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২.৩ বছর হলেও, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-ই রয়ে গেছে। ২০১১ সালে চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ বছর থেকে ৫৯ করা হলেও, বাড়ানো হয়নি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। যেখানে গত ৩২ বছরে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে প্রায় ২৩ বছর অথচ সেখানে ৫ বছর বয়স বাড়ানোটাকে যৌক্তিক মনে করছি না।

করোনা মহামারির বয়স বৃদ্ধির যে পদক্ষেপ ছিল সেটিও কোনও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত ছিল বলা যাবে না। কারণ, এই করোনাকালীন পুরো বিশ্বই থেমে ছিল। এখানে শিক্ষাজীবন হারিয়েছে সব বয়সের শিক্ষার্থীরা। অথচ এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র যারা শেষ সময়ে চাকরির আবেদন বঞ্চিত ছিলেন তারা। যে শিক্ষার্থী অনার্স প্রথম বর্ষে ছিলেন সে কিন্তু এর কোনও সুবিধাই পায়নি কিন্তু দু’বছর শিক্ষাজীবন ঠিকই হারিয়েছেন। অর্থাৎ এই করোনা মহামারিতে যারা শিক্ষাজীবনের বয়স হারিয়েছেন তারা তা স্থায়ীভাবেই হারিয়েছেন অথচ সুবিধা পেয়েছেন মুষ্টিমেয় কিছু চাকরি প্রত্যাশী। ক্ষতি যদি স্থায়ীভাবে হয়ে থাকে তার ক্ষতিপূরণ কেন সাময়িক এবং একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি পাবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

অনেক বিশ্লেষক বলেছেন বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে নাকি দক্ষতা ও সফলতার হার কম তাই বয়স বৃদ্ধি কোনও সমাধান নয়। যদি এটিই হয়, তাহলে দক্ষতার অজুহাতেই কেন অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর উন্নত বিশ্বের অধিক বয়স-সীমা রেখেও কীভাবে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।

যেভাবেই বলি না কেন, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি যুবসমাজ। এ যুবসমাজ তখনই মানবসম্পদে পরিণত হয়, যখন রাষ্ট্র তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করে এবং নিজেদেরকে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়। অন্যথায় এ বিশাল জনসম্পদ রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর সবচেয়ে মোক্ষম ধাপ হলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। যা বাংলাদেশ এই মুহূর্তে চলমান। এটিকে সঠিকভাবে কাজে না লাগাতে পারাটা যে কোনও দেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক।

অন্যদিকে বাংলাদেশের যুবনীতি অনুযায়ী, যুবকদের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩৫ বলা হয়েছে। আফসোসের বিষয়– বাংলাদেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ সীমাবদ্ধ করার কারণে আমরা উচ্চশিক্ষিত তরুণদেরকে ৩০ বছর পার হলেই অযোগ্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছি। একজন যুবক তার যুব নীতির শেষ পাঁচটা বছর পার করার আগেই চাকরির বাজারে তাকে মধ্যবয়সী হিসেবে গণনা করা হচ্ছে।

যে সনদ অর্জন করতে হচ্ছে জীবনের মহামূল্যবান ২৬-২৭ বছর আমরা তার বৈধতা দিচ্ছি মাত্র ৩-৪ বছর। সেই একই নীতি অনুসরণ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও।

সার্বিক বিশ্লেষণে এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, এতে রাষ্ট্রের বোঝা যেমন বাড়ছে, তেমনই রাষ্ট্র হারাচ্ছে একটি কর্মক্ষম বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে। তাছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য হলো তরুণ চাকরি প্রার্থীদের দুর্নীতিমুক্ত চাকরি উপহার। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেও তাদের সুযোগের দরজা খোলা রাখা উচিত। তাদের মেধার সততা দিয়েই সেটা অর্জন করুক। তাই মানবিক কারণেই নয় বরং যৌক্তিক কারণেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর দাবিটি ভেবে দেখুন। নাহলে হতাশায় আত্মহত্যা ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধ প্রবণতায় ডুবে যাবে আমাদের শিক্ষিত যুব সমাজ।

লেখক: নাট্যকার ও কলামিস্ট।
ইমেইল: kabilsadi@gmail.com