X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকনামা: জাতি গড়ার কারিগরদের আগে গড়ুন

কাবিল সাদি
১২ জুন ২০২৩, ১৬:২৩আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ১৬:৫৮

সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের নৈতিকতা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি সংবাদ ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে ভয়ানক অভিযোগ আকারে। তার মধ্যে কন্যাদের শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভিসি। তারা হলেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন। এক বছরের ব্যবধানে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে এই নিয়োগ হয় তাদের দুই কন্যার। এ ঘটনা জানাজানির পর চলছে ব্যাপক সমালোচনা। এদিকে আরও অস্বস্তিকর শিক্ষক সংক্রান্ত সংবাদ হলো কারমাইকেল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আহসান উল ফেরদৌসের সঙ্গে একই বিভাগেরে এক ছাত্রীর আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। শাস্তিস্বরূপ তাকে কারমাইকেল কলেজ থেকে লালমনিরহাট সরকারি কলেজে বদলি করা হলেও যোগদান করতে এলে মূল ফটকে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। তাকে কলেজে ঢুকতে দেননি শিক্ষার্থীরা। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

এছাড়া প্রাথমিক স্কুল, ওষুধ কোম্পানিসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি ৩৩তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডার। ভুক্তভোগীরা তার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে মোট ১১ জনকে চাকরি দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সদস্য অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আরও একধাপ এগিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। অতিরিক্ত তৈল মর্দন করতে গিয়ে সংবিধানকে তোয়াক্কা না করেই তার প্রস্তাব– নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সরকারের মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানোর জন্য। এরকম শত শত সংবাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি আমাদের খুব ছোট থেকেই শেখানো হয়। আর সেই মেরুদণ্ডের ভিত যেন শক্ত হয় সেই কাজটিই করে থাকেন শিক্ষক নামের মহান পেশার ব্যক্তিগণ। যে কথাটি আজ পর্যন্ত শিক্ষকদের মর্যাদা বুঝাতে যথেষ্ট মনে হয়েছে তা হলো ‘শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর’। এই কথাটি এত বেশি মাত্রায় প্রচলিত যে এর মাধ্যমে শুধু তাদের দায়িত্বকেই না বরং শ্রদ্ধাকেও শতগুণ বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে।

একটা সময় ছিল সবচেয়ে ভালো পরিবার বা ভালো মানুষের সারিতে প্রথম যে নামটা উঠে আসতো তা ছিল যথাক্রমে শিক্ষক বা শিক্ষক পরিবার। কখনও কখনও ‘মাস্টার সাহেবের বাড়ি’ বা ‘মাস্টার পাড়া’ এলাকা বা গ্রাম মহল্লাকে আলাদা ইতিবাচক পরিচিতি দিয়েছে। বংশ মর্যাদা ও ভালো মানুষের মানদণ্ডের বিচারে শিক্ষক শ্রেণি ছিল সর্বাগ্রে। এমনকি বিয়ের কনে বা বর পছন্দ তথা নতুন আত্মীয় তৈরিতে প্রাধান্য দেওয়া হতো বা এখনও দেওয়া হয় শিক্ষক পরিবারকেই।

সময়ের পরিক্রমায় সেই শিক্ষক পদবি বা পেশাটি নানা কারণেই বহুবার কলঙ্কিত হয়েছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই পরিস্থিতি দিন দিন তাদের আশানুরূপ মর্যাদাকে তলানিতে ঠেকানোর উপক্রম করেছে। তবে এটাও ঠিক যে অবশ্যই তা সাধারণীকরণ করার মতো পর্যায়ে এখনও যায়নি। তবে সেদিন যে আর বেশি বাকি নেই তারই নানা বিষয় আমাদের সামনে উঠে আসতে শুরু করেছে।

হাফিজিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক কর্তৃক অমানবিক ছাত্র নির্যাতন ও ধর্ষণ, শিক্ষক কর্তৃক স্কুল-কলেজের ছাত্রী ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি চর্চা ও যেকোনও ক্ষমতাসীন সরকারের চাটুকারিতা, শিক্ষক ও কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ক্লাসের পরিবর্তে কোচিং ব্যবসায় অধিক মনোযোগীসহ গবেষণা চুরির মতো জঘন্য অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্পৃক্ততার এসব সংবাদ সম্প্রতি জাতি গঠনের এই মহান পেশাটি চারিত্রিক স্খলনের সমাজের নিচু স্তরের অপরাধীর কাতারে নামিয়েছে।

কতিপয় ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় জাতির বিবেককে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। রক্ষক যেন আজকাল ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কারিগরি শিক্ষাতে চলছে ব্যবহারিক নম্বর দেওয়াকে কেন্দ্র করে নম্বর বাণিজ্য। অভিযোগ আছে তাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে বা বিশেষ শিট না নিলে আশানুরূপ নম্বর পাওয়া যায় না। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা ব্যতীত  ক্লাস বা শিক্ষা কার্যক্রম হয় না বললেই চলে। বিভিন্ন পরীক্ষার নামে রয়েছে অর্থ আদায়ের অভিযোগ।

স্বায়ত্তশাসনের অজুহাত দাঁড় করিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা হয়ে যাচ্ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লাল, নীল, সাদা দলের মোড়কে তাদের গবেষণার থেকে রাজনৈতিক চর্চা করতেই অধিক দেখা যায়। এরা শিক্ষক হিসেবে যতটা না নিয়োগ পান তার থেকেও বড় পরিচয় তারা নীল বা সাদা দলের ভোটার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে স্পষ্ট যে শুধু বিভাগের প্রথম হওয়াই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মূল যোগ্যতা নয়। বরং রাজনৈতিক পরিচয় অথবা প্রভাবশালী শিক্ষকের আত্মীয় স্বজন কিনা সেটাই মুখ্য।

ক’বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান তো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম-শৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতারাতি শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা পরিবর্তন করে তার মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অযোগ্য সিজিপিএ থাকা সত্ত্বেও। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও আইন অমান্যের দুর্নীতি দমন কমিশন পঁচিশটি অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। একজন শিক্ষকের থেকে ক্ষমতাশালী হলে আর কিই বা করতেন বা তার ইচ্ছে ছিল।

এই হলো স্বায়ত্তশাসনের নামে স্বেচ্ছাচারিতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও প্রায় একই অবস্থা। ফলাফল, বিভাগে প্রথম হওয়া ছাত্রছাত্রীদের বড় একটা অংশ হয় দেশের বাইরে নতুবা ব্যাংক বা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি খুঁজছেন বিভাগের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে। সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তাইফুর রহমানের মতো কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের আত্মহত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় অন্যান্য প্রার্থী অংশ নিলেও এমদাদুল হক নামের সেই প্রার্থীকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। অথচ যিনি স্নাতকোত্তর ও স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। দিনে-দুপুরে অপহরণ করে তার শিক্ষক নিয়োগে বাধা দিয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্রকে প্রথম হওয়া থেকে বঞ্চিত করতে শেষ সেমিস্টারে অকৃতকার্য করা বা সর্বনিম্ন নম্বর দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। আর এর ফলাফল প্রভাব ফেলে উঠতি বয়সের হাজার স্বপ্ন দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তরুণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ওপর। তারাও এতদিনে বুঝে গিয়েছেন শিক্ষক হওয়ার রাস্তা এখন পড়াশোনা বা গবেষণাই মুখ্য নয়, বরং হাঁটতে হবে পেছনের রাস্তাতেও।

ফলে পড়ুয়া কিংবা গবেষক শিক্ষক আমাদের চোখে পড়ছে না। অরাজনৈতিক মানবিক যে কয়জন শিক্ষক থাকেন তারাও এদের কারণে দিনের পর দিন কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তারা তাদের বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মকানুন বা পড়াশোনার মান উন্নয়নে তেমন ভূমিকা না রেখেই একদিন নীরবে অবসরের পথ ধরেন।

গত দুই দশকে এটাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে দল রাজনৈতিক ক্ষমতায় এসেছে তাদের ছত্রছায়ায় এসব শিক্ষকে সয়লাব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই প্রক্রিয়া এখনও ভয়ানকভাবে চলমান। এখানে এভাবে নিয়োগ পাওয়াই শেষ কথা নয়, বরং পদোন্নতি, হল প্রভোস্ট বা বিভাগের চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। ফলে এখানে এসবের জন্য গবেষণা বা উচ্চতর ডিগ্রি ততটা ভূমিকা রাখে না, আর যা রাখে তা আমাদের শিক্ষক মহোদয়গণ বিদেশি থিসিস বা গবেষণার সিংহভাগ চুরি করে সে শর্ত পূরণ করেন।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় কুম্ভিলক শিক্ষকদের গবেষণাপত্র চুরির সন্ধান পাওয়া গেছে। আর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বলতে কথিত তদন্ত কমিটি গঠন করা বা সতর্ক করে দেওয়াই সর্বোচ্চ শাস্তি। অবশ্য রাজনৈতিকভাবে বিপক্ষ দল হলে শাস্তির মাত্রা আপেক্ষিক হয়ে থাকে।

এভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকগণ তাদের রাজনৈতিক প্রভাবে নামে বেনামে বাহারি রকমের নতুন বিভাগ খুলে বসেন। আবার সেই বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। তারা শিক্ষক পরিচয় থেকে নিজেকে সাদা নীল দলের পদাধিকারী বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নামে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানটিকেও অতীতে এ ব্যাপারে তেমন শক্ত কোনও বিশেষ ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং ‘তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বক্তব্যেই তাদের সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে।

বিশ্বের অন্য কোথাও শিক্ষকদের মধ্যে এত ‘সাদা-নীল’ নামে রাজনীতি কাজ করে কিনা বা করলেও এত প্রখর কিনা তা আমাদের জানা নেই। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে যে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, এটি সত্যিই বিরল। কারও কারও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এত উচ্চমাত্রার যে তা অকল্পনীয়। কিছু দিন আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মিজানুর রহমান তো সরাসরি বলেই দিলেন যে যুবলীগের চেয়ারম্যান করা হলে তিনি উপাচার্য পদ ছাড়তেও রাজি। তার এই রাজনৈতিক চাহিদা এ দেশের প্রেক্ষাপটে খুব সাধারণ। তার এই মনোবাসনা আজকাল অধিকাংশ শিক্ষকগণই হয়তো পোষণ করেন, হয়তো প্রকাশ করেন না, তার বড় কারণ এখানে অবৈধ ক্ষমতা চর্চা প্রখর। তাই যে যে পদেই থাকুন সবারই শেষ ইচ্ছা অন্ততপক্ষে শেষ সময়ে হলেও রাজনৈতিক পদে আসা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন, যিনি ট্রেনে প্রায় তিনশত কিলোমিটার রাস্তা দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন তার গৃহকর্মী এক বাচ্চাকে। এই শিক্ষক ও তার সন্তান আরামে চেয়ারে বসে যেতে পারলেও এই শিশুর জন্য সিট নেওয়ার টাকা তিনি আজও উপার্জন করতে পারেননি। অথচ ‘শিশুশ্রম’ নিয়ে টকশোতে ডাকলে তিনিই এই শিশুশ্রমের বিরোধিতা করে তার অধ্যাপনা সংশ্লিষ্ট বিভাগের সংবিধান তুলে ধরবেন।

অথচ ব্যক্তি ও বাস্তব জীবনে একজন শিক্ষক থেকে ওই শিশু বা আগামী প্রজন্ম কী শিখবে। জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে তার আদর্শ কতটা নৈতিকতা ধারণ করে। তার এই আদর্শের খবর আমরা পড়ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নানা পেজে ঘুরে।
সাধারণভাবে তাদের এসব কর্মকাণ্ড হয়তো অন্যান্য অপরাধীর মতো সাধারণ মনে হলেও একজন অধ্যাপকের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এসব কোনও নতুন ঘটনা নয়। আরেকটু পেছনে গেলে দেখা যায়, ২০২০ সালের মহান বিজয় দিবসে আমাদের দেখতে হলো আরেক নজিরবিহীন বিজয় দিবস উদযাপন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ মিনারের ছবি যুক্ত করে উদযাপন করেছেন মহান বিজয় দিবস। যে অনুষ্ঠানে উপস্থিতও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

যারা এসব কাজে যুক্ত তারা কেউই মানসিক ও মানবিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিনা সেটা ভাববার বিষয়। আর তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন এই ইতিহাস চর্চার আদৌ কোনও প্রয়োজন আমাদের আছে কিনা সেটাও ভাবার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানচর্চা ও এদের দায়িত্বে কারা রয়েছেন এবং তারা শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের দেশপ্রেমকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনই পদক্ষেপ নিতে।
শিক্ষকদের এই যে অনৈতিক অবস্থা তার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে তারই উত্তর হিসেবে বড় উদাহরণ তৈরি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমালোচিত সেই উপাচার্য অধ্যাপক সোবহান। তার শেষ দিনে ‘মানবিক’ কারণে নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষক জনাব ইন্দ্রনীল মিশ্র, যিনি শিক্ষক হওয়ার জন্য নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাগত যোগ্যতা তো অর্জন করতে পারেনইনি, বরং এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আরও মজার বিষয় হলো, তিনি ভর্তি পরীক্ষায় না টিকেও তার পিতা অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকার কোটা সুবিধা নিয়ে ভর্তির সুযোগ পান। এখন প্রশ্ন হলো এই অকৃতকার্য শিক্ষক কীভাবে জ্ঞানদান করে তার ছাত্রকে কৃতকার্য করবেন?

পিতা প্রভাবশালী শিক্ষক হলেই কি সব বৈধতা দেওয়া যায়? এমন অনৈতিক একজন শিক্ষকই বা এতদিন তার ছাত্রদের কী নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছেন সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। তার থেকে শিক্ষা অনুরাগী ছাত্ররাই বা জাতি গঠনে দেশ সেবায় কতটা নৈতিকতা শিখবে। প্রায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এই সংকটে আবদ্ধ।

এই সংকট নিরসন না হলে জাতি গড়ার কারিগর এই মহান পেশার প্রতি মানুষের যেমন আস্থাহীনতা তৈরি হবে, একই সঙ্গে ধ্বংস হবে পুরো জাতি। তাই সময় এসেছে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’- এই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী ও সুস্থ রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে নিরপেক্ষ যোগ্য ব্যক্তি দিয়ে পরিচালনা করা এবং মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মতো একটি স্বাধীন বিতর্কহীন স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের আদলে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার প্রতিষ্ঠান গঠন করা। অন্যদিকে পেশাভিত্তিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে অন্যান্য শিক্ষকদের ভূমিকা রাখতে হবে লেখা, বক্তৃতা বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভুলে গেলে চলবে না ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অগ্রভাগে।

এছাড়াও অধ্যাপক শামসোজ্জাহা, স্যার এ এফ রহমান, জিসি দেব, হুমায়ুন আজাদ বা সদ্য প্রয়াত আনিসুজ্জামানসহ বরেণ্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, তারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকেই তুলে ধরেছেন তাদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। এখনও যদি শিক্ষকদের দলবাজি বা রাজনীতি বন্ধ না হয় এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না আসে তাহলে হয়তো জাতি গঠনের কারিগর না হয়ে জাতি ধ্বংসের কসাই হিসেবে পরিণত হবে। তখন সে লজ্জা শুধু শিক্ষকগণই নন, ক্ষতিগ্রস্ত করবে আমাদের সমাজ ও পুরো জাতিকে। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যেমন রোগী নিরাপদ নয়, ঠিক একইভাবে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া এবং এসব নিয়োগদানকারী  নৈতিকতাবিহীন এই হাতুড়ে শিক্ষকদের হাতেও জাতি গঠন অসম্ভব।
তাই জাতি গড়ার কারিগরদেরই আগে সুশিক্ষায় গড়ে নিতে হবে অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ ও নৈতিক মেধার ভিত্তিতে। তাই সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্টদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা জাতি গঠনের কারিগর নাকি জাতি ধ্বংসের কসাই নিয়োগ দেবো।

লেখক: কলামিস্ট ও নাট্যকার।
Email: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ