গণমাধ্যমের নারীরা কি কেবলই পণ্য?

এ দেশে নারী দিবস উদযাপন করা হচ্ছে এক-দুই বছর নয়, ৫৩ বছর ধরে। এই এক দিন নারীকে কেমন করে জায়গা করে দিতে হবে, কেমন করে তাদের উন্নতি ও অগ্রগতি হবে, কেমন করে অধিকার আদায় হবে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। যারা এই আলোচনায় অংশ নেন, গুরুগম্ভীর বক্তব্য রাখেন, তারাই অফিস বা কর্মস্থলে নারীদের উন্নতিতে কোনও সহায়তা করেন না। বরং পুরুষের তুলনায় তারাই নারীকে অযোগ্য মনে করেন।

তবুও ৫৩ বছরে নারীরা যে এগিয়ে যাননি তা নয়, সেই এগিয়ে যাওয়ার গতি কত, সেটি হলো প্রশ্ন।

যদি সব খাতের কথা বলতে হয় তাহলে একটা বই লিখতে হবে। যেহেতু সাংবাদিকতা করি। গণমাধ্যমের কথাই বলি। সে ৭৮ বছর আগের কথা। ১৯৪৭ সালে বেগম পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন নুরজাহান বেগম। যদিও প্রতিষ্ঠার প্রথম চার মাস পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামালএরপরই নুরজাহান বেগম সম্পাদক হন এবং সাহসিকতার সাথে নারীদের প্রথম পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকেন, যখন নারীদের ছবি তোলায় অনেকের আপত্তি ছিল, পর্দা ছাড়া নারীরা বের হতে পারত না, লেখালেখি করা ছিল স্বপ্নের মতো। সেই আমলে মেয়েদের প্রথম পত্রিকা, তার ওপর সেটি প্রকাশ করেছিলেন কয়েকজন আলোকপ্রাপ্ত মুসলিম নারী।

এ ঘটনা ঐতিহাসিক অমলিন হয়ে আছে আজও। বাবা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহিত্যচর্চায় মেয়েদের জায়গা করে দিতে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তবুও সে সময়ে এটিকে প্রতিষ্ঠা করার অবদান ছিল মহিয়সী এই নারীর যিনি খবরের পাতায় তুলে আনেন নারী জাগরণ, নারী স্বাধীনতা থেকে নারী অধিকার। তারপর?

স্বাধীন এই দেশ প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা এখন ২ হাজার ৬৫৪টি। এর মধ্যে দৈনিক এক হাজার ২৪৮, সাপ্তাহিক এক হাজার ১৯২ এবং পাক্ষিক পত্রিকার সংখ্যা ২১৪টি। খোদ সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এই তথ্য জানিয়েছিলেন। আর টিভিার সংখ্যা ৪৪ টি।

এখন আসি আসল কথায়। এই দেশের ১ হাজারটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের মধ্যে মাত্র দুই জন নারী। এবার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিক তাকাই। সম্পাদক  পদে কেউ নেই। সিইও পদে দুই জন ছিলেন সামিয়া জামান এবং মুন্নী সাহা। বর্তমানে মুন্নী সাহা ১ টাকার খবর নামের একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের প্রধান। এর বাইরে আর কোনও মেয়ে কোথাও নেই। সম্পাদক তো দূর, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিচের ৫টি  ধাপে কিছু পত্রিকায় থাকলেও টেলিভিশনে কোনও মেয়ে নেই। নেই মানে আসতে দেওয়া হয় না। কেবল গণমাধ্যম ব্যবসায় মালিকরাই যে ছেলেদের প্রধান হিসাব চান তা নয়, সাংবাদিকরাও যারা মালিক হয়েছেন বা যারা সম্পাদক বা যারা নিউজরুমে বড় পদে কাজ করেন, কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া নারীদের বেশি দূর পর্যন্ত দায়িত্ব দিতে চান না। অথচ তারাই বলেন নারী অগ্রগতির কথা।

কেন দিত চান না? এর কোনও একক উত্তর নেই। এমনকি এই উত্তর আমিও জানার চেষ্টা করি। টেলিভিশন মিডিয়াতে নারীদের কেবল দেখানো প্রডাক্ট হিসাবে ব্যবহার করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন নিউজ রুম ব্যবস্থাপকরা। তারা বড় পদে বসবেন, সাংবাদিক সামলাবেন, নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবেন- এই জায়গা ছেড়ে দিতে চান না। এরপরও কেউ কেউ বেড়ে ওঠেন তখন অনেক যুদ্ধের পর তাকে হয়তো কেবল পদটাই দেওয়া হয় কিন্তু সব কাজের ভার দেওয়া হয় পুরুষকেই।

মেধা কম? পরিশ্রম কম করে? সময় কম দেয়? মোটেই তা নয়। বরং ছেলেদের তুলনায় তারা কাজ বেশি করে সততা আর নিষ্ঠার সাথে। তবুও এ এক আজব অবস্থা যেখানে নারীকে কোনোভাবেই প্রধান হিসাব মেনে নিতে চান না পুরুষ সহকর্মীরা। যতই তার অভিজ্ঞতা ২৫ বা ৩০ বছরের হোক। তাকে শুকনো পাতা হিসাবে ঝরে যেতে হয়, তিনি বৃক্ষ হতে পারেন না।  

আমরা অগ্রগতির কথা বলি, সাম্যবাদের কথা বলি ঠিক, কিন্তু এসবই কেতাবি ভাষা। বিশেষ দিন উদযাপনের   হাততালি পাওয়া কড়া বক্তব্য। যে গণমাধ্যমে নারীদের অবহেলা, অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে সেই গণমাধ্যমের ভেতরের অবস্থা প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো।  

কেবল নারীর পক্ষ্যে বিশেষ দিন জ্বালাময়ী বক্তব্য নয়, কেউ এগিয়ে আসুন, দেখান যে নারীর ওপর আস্থা রাখতে পারেন আপনি সেই অগ্রদূত।

লেখক: সাংবাদিক