বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে দাবদাহ বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও নতুন নতুন রেকর্ড হয়েই চলেছে। এর আগে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল আগের ২৬ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হয়েছিল বাংলাদেশে এবং ওইদিন দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ২০ এপ্রিল যশোরে ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি। যদিও একসঙ্গে অনেক জায়গায় ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে এবার। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, একটি জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা, তা থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেড়ে গেলে এবং সেটি পর পর পাঁচ দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলা হয়।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণা মতে, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। আবহাওয়া দফতরের হিসাবে বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। দেশে তাপমাত্রার এই ওয়েভ এখন ৪৩ ছুঁই ছুঁই। এভাবে সারা পৃথিবীতেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ১০০ বছরে এই তাপমাত্রা গড়ে ১ ডিগ্রি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স দেশে তাপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গ কিলোমিটারের সম-আয়তনের জলাধার এবং ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে। এখন জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন নির্মাণ চলছে। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলে তাপ আটকে রাখে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে বন উজাড়ের ফলে গাছপালা কমে যায়, যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। গাছপালা কমে গেলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
একটি শহরের সুস্থ ও বাসযোগ্য পরিবেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সবুজের প্রয়োজন। দেখা যায় শহরে যে এলাকায় গাছ বেশি সে এলাকায় তাপমাত্রা কম। তাই তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে ঢাকায় নগর বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, বৃক্ষ সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতি ও বাতাসে জলীয়বাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উষ্ণতা কমিয়ে দেয় ঠান্ডা আবহাওয়া। তাই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পরিবেশ ঠান্ডা রাখা যাবে। নিজেদের বসতঘর শীতল রাখার জন্য লাগানো যেতে পারে মানিপ্ল্যান্ট, পাম, অ্যালোভেরা, ছোট রাবার গাছ ও স্নেকপ্ল্যান্ট জাতীয় গাছপালা। এগুলো আশপাশের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে বলে ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, এই উদ্ভিদগুলোর অসংখ্য ঔষধি গুণের পাশাপাশি বাতাস থেকে কার্বন গ্যাসসহ বিষাক্ত পদার্থ শোষণ, তাপ ও অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে। এদের দু-একটি বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন যুক্ত করতে পারে, যা উষ্ণতা হ্রাস করতে সহায়ক। তা ছাড়া গাছ বাতাস থেকে শুষে নিতে পারে গ্রিনহাউজ গ্যাস। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত, গাছ লাগানো প্রাকৃতিক বনের বিকল্প হতে পারে। ২০১৯ সালের দিকে ‘ফ্রন্টিয়ার ইন ফরেস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল চেঞ্জ’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখানো হয়, বিদ্যমান বনগুলোকে সেগুলোর পরিবেশগত সম্ভাবনা অক্ষত রেখে বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়াই বেশি কার্যকর উপায়। এটিকে বলে ‘প্রোফরেস্টেশন’। এই কৌশল বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাস অপসারণ এবং সংরক্ষণের জন্য বেশি কার্যকর। আর এতে ব্যয়ও কম।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ও একটি নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে নাগরিক এবং ভোক্তাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের জীবন থেকে এমন কিছু ভূমিকার কথা তুলে ধরা হলো, যেগুলো নাগরিকরা চাইলে পরিবর্তন কিংবা অনুশীলনের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে মোক্ষম ভূমিকা পালন করতে পারেন।
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে হাঁটা, সাইক্লিং বা গণপরিবহনের ব্যবহার কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার পাশাপাশি নগরবাসীদের ফিট রাখতে সাহায্য করবে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর উপচেয়ারম্যান ড. ডেব্রা রবার্টস বলেছেন, ‘আমরা শহরে চলাচলের বিকল্প উপায় বেছে নিতে পারি, যদি গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে আমাদের প্রবেশাধিকার না থাকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে নাগরিকদের আরেকটি করণীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শক্তির অপচয় রোধ করা। যেমন- ওয়াশিং মেশিনে যদি কাপড় ধুতেই হয় তাহলে সেটি শুকানোর কাজ মেশিনের টাম্বেল ড্রায়ারে না করে, বাইরের রোদে বা বাতাসের মধ্যে দড়িতে মেলে দিতে পারে। এতে কাপড় শুকানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।’ অন্যদিকে ঘর ঠান্ডা করতে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর চেয়ে বাড়িয়ে রাখতে পারেন। ঘর গরম করতে হিটারের তাপমাত্রা কমিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও পরেরবার যখন কোনও বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনবেন, তখন এটি দেখে নেবেন যে যন্ত্রটি শক্তি সঞ্চয়ে দক্ষ কিনা। (টিপস: যন্ত্রের গায়ে শক্তি সঞ্চয়ের তারকা চিহ্নযুক্ত লেবেল, ইকো ফ্রেন্ডলি অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি অথবা ইনভার্টার যুক্ত আছে কিনা দেখে নিতে পারেন)।
পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় কিছু কাজের জন্য আপনি পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করতে পারেন। যেমন- পানি গরম করতে সৌরশক্তি চালিত সোলার ওয়াটার হিটার ব্যবহার করতে পারেন। শীতকালে বাড়ির স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ছাদে ঠান্ডা প্রতিরোধক স্তর স্থাপন করতে পারেন। গরমকালেও ছাদ ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা নিতে পারেন।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ১১৯টি দেশ কৃষি খাতে কার্বন নির্গমন কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। তবে তারা কীভাবে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এ বিষয়ে কোনও নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও একজন নগরবাসী চাইলে এই কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করতে পারেন। আর সেটা অনেকাংশেই সম্ভব হবে যদি তিনি তিনটি বিষয় মেনে চলেন। যেমন, একজন নাগরিক খাদ্য অভ্যাসে মাংসের পরিবর্তে সবজি এবং ফলের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে পারেন। যদি এটি খুব চ্যালেঞ্জিং মনে হয়, তাহলে তিনি সপ্তাহের অন্তত একদিন মাংস না খেয়ে কাটাতে পারেন। পাশাপাশি তিনি দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া কমিয়েও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারেন। কেননা, এসব খাদ্যের উৎপাদন ও পরিবহনে প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয়। অন্যদিকে আমদানি করা খাবারের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মৌসুমি খাদ্য বেছে নিলে এবং খাবারের অপচয় এড়িয়ে চললে কার্বন নিঃসরণ কমাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পরিশেষে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা আর কোনও ভবিষ্যতের বিষয় নয়। তাই ভোগের মানসিকতায় বাসযোগ্য পৃথিবী সম্ভব নয় এটি মনে রাখতে হবে সবার আগে। বিশ্ব এখন ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কিন্তু বর্তমানে যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে তাদের পাশে এখনও কাউকে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রতিটি নগরীর নাগরিকরা যদি তাদের জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে নগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলে নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে তা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যার ফলে অনেকাংশেই সম্ভব হবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো বড় বাধাকে প্রতিরোধ করা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।