সফট পাওয়ার: তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা

সম্প্রতি এক বহুজাতিক কোম্পানির আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন তুরস্কের সুপারস্টার জনপ্রিয় সিরিজ ‘কুরুলুস উসমান’-এর অভিনেতা বুরাক অ্যাজিভিট। শোরুমে এবং রাস্তায় তাকে দেখতে দেশের হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান। বিভিন্ন টিভি সিরিজের কল্যাণে বহির্বিশ্বে তুরস্কের ইমেজ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের তারকারা এখন বিশ্বব্যাপী সত্যিকারের সুপারস্টার। আমার কাছে যেটা অবাক লেগেছে তা হলো, খুব অল্প সময়ের মধ্যে কালচারাল ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে তুরস্কের ঐতিহ্য, পর্যটন, খাদ্য, পোশাক, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে তা ভালোভাবেই কাজ করছে। বিশ্বে তুরস্কের সফট পাওয়ার যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা নিয়ে  হয়তো কিছু বলার নেই। ‘কোরিয়ান ওয়েভের’ মাধ্যমে কোরিয়ার পপ মিউজিক (কে-পপ), সিনেমা, নাটকের সাফল্য তো বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছে।  বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যান্ডের, সিনেমার জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এ নিয়ে গত জানুয়ারি মাসের একটি ঘটনা হয়তো সবাই জানেন। দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ব্যান্ডদল বিটিএসের ভক্ত রাজধানীর তিন কিশোরী এই ব্যান্ড দলের এক তারকাকে বিয়ে করার জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে বিটিএসের টানে ঘর ছাড়া এই তিন কিশোরীকে পুলিশের সাহায্য নিয়ে উদ্ধার করতে হয়!

দক্ষিণ কোরিয়ার বা তুরস্কের মতো দেশের এই সংস্কৃতি রফতানি শুধু যে আমাদের মতো দেশসহ বিশ্বব্যাপী তাদের তারকাদের জনপ্রিয়তা এনে দিচ্ছে তা নয়, তাদের সফট পাওয়ার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্র্যান্ড ফাইন্যান্সের গ্লোবাল সফট পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৪ অনুসারে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান ১৫তম, তুরস্কের ২৫তম, ভারতের ২৯তম, পাকিস্তানের ৮১তম এবং বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬তম।

অনেকেই হয়তো জানেন যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাঈ ২০১১ সালে তার দ্য ফিউচার অব পাওয়ার গ্রন্থে সফট পাওয়ারের ধারণাটা জনপ্রিয় করে তোলেন। তার মতে, সফট পাওয়ার অর্জিত হওয়ার প্রধান সম্পদই হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতি, দ্বিতীয়টি তার রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং তৃতীয়টি হচ্ছে তার পররাষ্ট্রনীতি। ব্র্যান্ড ফাইন্যান্সের মূলত এই তিনটির ওপর ভিত্তি করে আরও কয়েকটি সূচকের মাধ্যমে সফট পাওয়ার ইনডেক্স করেছে।

যে কারণে আমার এ লেখার অবতারণা তা হচ্ছে আমরা কি দক্ষিণ কোরিয়া বা তুরস্কের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে অন্যান্য দেশে জনপ্রিয় করে তুলতে পারি না? আমার যতটুকু মনে পড়ে, সফট পাওয়ার নিয়ে আমি আগেও লিখেছি বাংলা ট্রিবিউনে। কিন্তু আমার মনে হয় সময় এসেছে এখন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেওয়া – যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান ওয়েভ বা তুরস্কের কালচারাল ডিপ্লোম্যাসি বা গ্লোবাল টার্কিশ ব্র্যান্ড জনপ্রিয় করার স্ট্র্যাটেজিসমূহ আমাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে বহির্বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সিনেমা, নাটক বা গান যে বিদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশের যে সুবিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, লোকজ গান, হস্তশিল্প ইত্যাদি রয়েছে তা বিশ্বদরবারে খুব কমই জায়গা করতে পেরেছে। কিছু সিনেমা হয়তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কার পাচ্ছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কিছু নাটক হয়তো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, কিন্তু তা বিচ্ছিন্ন মাত্রায়। অথচ আমাদের রয়েছে অসম্ভব মেধাবী শিল্পী, অভিনেতা, পরিচালক। কিন্তু যে ব্যাপক মাত্রায় সরকারি বিনিয়োগ ও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন– বিশেষত তুরস্ক বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো, তা আমাদের দেশের শিল্পীরা পাচ্ছেন না। সমন্বিত কোনও কৌশলের কথাও আমি অন্তত জানি না।

সফট পাওয়ার বৃদ্ধির তো একটি অর্থনৈতিক দিক রয়েছে, যা অস্বীকার করা যায় না। এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে তুরস্ক এখন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পর তৃতীয় টিভি সিরিজ রফতানিকারক দেশ! ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কের টিভি সিরিজ রফতানি বেড়েছে ১৮৪ শতাংশ এবং ২০২২ সালে তুরস্কের টিভি সিরিজ রফতানির আয় ছিল ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিনেমা ও টিভি সিরিজ আন্তর্জাতিকীকরণ এবং জনপ্রিয়করণের ক্ষেত্রে তুরস্কের কালচার এবং ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক মাত্রায় সহযোগিতা রয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার কথা তো বলাই বাহুল্য। ইনভেস্ট কোরিয়ার হিসাব অনুসারে, ২০২১ সালে মিউজিক, সিনেমা ইত্যাদিসহ কোরিয়ার মোট কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রির রফতানি ছিল ১২.৪৫ বিলিয়ন ডলার! এটা তো অনেকের চিন্তার বাইরের একটি সংখ্যা।  

এবার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের দিকে স্বল্প সময়ের জন্য একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক। আমাদের পাশের দেশ ভারতের সিনেমা পৃথিবীর ৯০টি দেশে রফতানি হয়, জিডিপির ২ ভাগ আসে সেখান থেকে। তবে বিস্ময়কর হচ্ছে পাকিস্তানি টিভি সিরিজের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, নেপাল এমনকি বাংলাদেশেও নাকি পাকিস্তানি টিভি নাটক বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে!

সে তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি বলা যায়। বাংলাদেশের এখন উচিত এসব দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের সফট পাওয়ার বৃদ্ধি করা।

বাংলাদেশ তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া এদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের আদলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে নিয়োজিত করতে পারে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার কালচার ও কনটেন্ট বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোরিয়া ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট এজেন্সি বা KOCCA অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। KOCCA হলো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেটি কোরিয়ান কনটেন্ট প্রচার তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করে। সবাই জানেন যে কোরিয়ান কনটেন্টের মধ্যে রয়েছে কোরিয়ান নাটক (কে-ড্রামাস), কোরিয়ান মিউজিক (কে-পপ), কোরিয়ান বিউটি, কোরিয়ান ফ্যাশন, কোরিয়ান গেমস এবং কোরিয়ান অ্যানিমেশন।

KOCCA কোরিয়ান ব্রডকাস্টিং ইনস্টিটিউট, কোরিয়া গেম এজেন্সি এবং কোরিয়া কালচার অ্যান্ড কনটেন্ট এজেন্সিদের সমন্বয়ে কাজ শুরু করেছিল।

বাংলাদেশেও এরকম সমন্বিত প্রতিষ্ঠান দরকার দেশের কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির যুগে দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। তুরস্কের নাটক ইউটিউবে বিভিন্ন ভাষায় সাবটাইটেল দিয়ে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা কালচারাল এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে শুধু সিনেমা, নাটক এ ধরনের সনাতন মাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন ধরনের জনরা বা কনটেন্ট ব্যবহার করতে বলেন। যেমন, অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্কদের আকৃষ্ট করার জন্য অনলাইন গেমিং, অ্যানিমেশন, ওয়েবটুন ইত্যাদি।

একটি রাষ্ট্রের সফট পাওয়ার যে শুধু ইমেজ বৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক কারণে দরকার তা নয়। এটি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গেও এটি সম্পর্কিত। জোসেফ নাঈ বলেছেন, সফট পাওয়ারের মাধ্যমে একটি দেশ সামরিক শক্তির পরিবর্তে তার প্রভাব ব্যবহার করে পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশ বিভিন্ন উপায়ে সফট পাওয়ার বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে তার জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করতে পারে।  

লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ইমেইল: shamsulbkk@gmail.com