ভুল চিকিৎসা, অবহেলা ও ডাক্তারের শাস্তি প্রসঙ্গ

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা হার্ট, ফুসফুস, কিডনি প্রতিস্থাপন করছেন। জোড়া লাগানো মাথাও আলাদা করছেন তারা। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো খবর। যখন এসব খবর গণমাধ্যমে আসে; তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। আশায় বুক বাঁধি। চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যায়। মনে মনে তাদের স্যালুট জানাই। আবার ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলার খবরে হতাশ হই। মনটা ভারাক্রান্ত হয়। একদিকে চিকিৎসকরা যখন হার্ট, ফুসফুস, কিডনি প্রতিস্থাপন করে সারা দেশের মানুষকে আনন্দে ভাসিয়ে রাখছেন; ঠিক সেই সময় আবার খতনা কিংবা প্রসব করানোর সময় রোগীর মৃত্যুর খবরে বিষাদ নেমে আসছে।

যে চিকিৎসকরা হার্ট, ফুসফুস, কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারছেন; তারা অবশ্যই বিশ্বমানের ডাক্তার। তাদের যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা কিংবা কর্তব্যপরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু যারা খতনার মতো সাধারণ চিকিৎসায় মানুষ মেরে ফেলছেন; তাদের কী বলা যায়? অবশ্যই অদক্ষ, অযোগ্য ডাক্তার বলতে হবে। ভুল চিকিৎসা বলতেও দ্বিধা থাকার কথা নয়। কেননা, প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইসলামের নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময়ে খতনার প্রচলন হয়। অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত হাজাম (নাপিত) খতনা করলেও তাদের হাতে কোনও শিশু মারা যাওয়ার নজির নেই। অথচ ‘বড় ডিগ্রি’ পাওয়া ডাক্তারের হাতে যখন খতনার সময় শিশু মারা যায়; সেটাকে অবশ্যই ভুল চিকিৎসা বলতে হবে। যদিও ভুল চিকিৎসা বলার অধিকার আমার-আপনার নেই। এটা বলতে পারবে কেবল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।

চিকিৎসায় অবহেলা কিংবা ভুলের ঘটনায় মামলাও হয়েছে। সেই মামলায় চিকিৎসককে গ্রেফতারের নজিরও দেশে রয়েছে। কিন্তু বিএমডিসির সনদ বাতিলের নজির বিরল। ভুল চিকিৎসার দায়ে মাত্র একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। চার জনের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে এক বছরের জন্য। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুসহ গত ২০ বছরে বিএমডিসিতে পাঁচ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে অর্ধেক অভিযোগই নিষ্পত্তি করতে পারেনি সংস্থাটি। এতে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই ধরনের অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদফতরেও জমা পড়ে।

তবে সেখানে এ পর্যন্ত কত অভিযোগ জমা পড়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও হিসাব নেই কারও কাছে। ভুল চিকিৎসায় প্রতি বছর কতজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে; সেই হিসাবও কারও কাছে নেই। মাঝে-মধ্যে ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলার খবর আসে। তখন কিছুটা নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শুরু হয় অভিযান। কয়েক দিন পর আবার সব কিছু আগের মতোই হয়ে যায়।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভুল চিকিৎসায় রাজীব আহমেদ নামে এক প্রকৌশলীর মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করেছেন তার বন্ধু ও স্বজনরা। দেশের প্রখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম ইউ কবীর চৌধুরী তার চিকিৎসা করছিলেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে ভুল চিকিৎসায় ইসমত আরা (৩৪) নামে অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ১৩ অক্টোবরের এ ঘটনায় ওই নারীর স্বজনরা শ্রীপুর পৌরসভার মাওনা চৌরাস্তার আল হেরা হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর এলাকায় হোলি ল্যাব মেডিকেল সার্ভিসেস লি. নামক একটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় আছিয়া খাতুন নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পর হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে চিকিৎসক ও ক্লিনিক সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় সোনিয়া (২৩) নামে এক সিজারিয়ান রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।

পরে বিক্ষুব্ধ জনতা ‘রাবেয়া প্রাইভেট হাসপাতাল’ ভাঙচুর করেন। প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর খবর আসছে। এ জন্য ডাক্তারদের অবহেলাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বড় কথা হলো- ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলেও ডাক্তারের শাস্তির নজির নেই। এমনকি ব্যবস্থা নিতে পারে না বিএমডিসি।

সংস্থাটি বলছে, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে মাঝপথে অভিযোগ উঠিয়ে নেন রোগীর স্বজন। এতে বিপাকে পড়তে হয়। জনবল ও বিচারিক সক্ষমতার অভাবে বিচারে এই ধীরগতি। প্রতিষ্ঠানটির নেই নিজস্ব ভবন, দক্ষ জনবলের সংকটও তীব্র। এছাড়া নানা সংকটে প্রতিষ্ঠাটি জর্জরিত। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, রোগীর স্বজনরা কেন মাঝপথে অভিযোগ তুলে নেন? নাকি অভিযুক্ত ডাক্তার অভিযোগকারীকে ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন। সেটা হতে পারে অর্থের বিনিময় কিংবা হুমকি-ধমকি বা চাপ প্রয়োগ।

বিএমডিসির জেল-জরিমানা করার বিধান নেই। তারা কেবল নৈতিকতা দেখে থাকেন। অভিযুক্ত ডাক্তার অনেক সময় আদালতের আদেশ মানেন না। যেমন সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত। তবে তা উপেক্ষা করে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখছেন বলে সংবাদ-মাধ্যম বলছে।

বর্তমানে বিএমডিসির নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ১০৪ জন। দন্ত চিকিৎসক প্রায় ১৩ হাজার, চিকিৎসা সহকারী প্রায় ২৭ হাজার ৯৪২ জন। প্রতিবছর সাড়ে ১১ হাজার নতুন চিকিৎসক যুক্ত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে। রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী আইন জরুরি বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, যেকোনও অপরাধের শাস্তি পর্যাপ্ত না হলে সেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তির বিধান রাখা উচিত। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছিলেন, চিকিৎসক ও রোগীর সুরক্ষার দায়িত্ব আমার। দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে আইন হচ্ছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে কমে আসবে এ (ভুল চিকিৎসা ও অবহেলা) পরিস্থিতি।

এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসায় অবহেলা বলতে কী বোঝায়? এই প্রশ্নের চিকিৎসকের কাছে যখন একজন রোগী সেবা নিতে আসেন, তখন তাদের মধ্যে একটি অলিখিত সুনির্দিষ্ট চুক্তি সৃষ্টি হয়। সেখানে সেবা প্রদানের বিষয়টি মুখ্য। এই অবস্থায় চিকিৎসকের অবহেলায় যদি কোনও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে তার আইনি প্রতিকার লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ বা চিকিৎসায় অবহেলা বলতে মূলত চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের অবহেলাকেই বোঝায়। রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার; ফি নিয়ে দরকষাকষি; ভুল ওষুধ দেওয়া; মৃত রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা; রোগীর ওপর জোর খাটানো; চিকিৎসা না দিয়ে অন্যত্র পাঠানো; আইনি জটিলতার কথা ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেলে রাখা; শয্যা খালি না থাকার অজুহাতে চিকিৎসা না দেওয়া; স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ভুল রিপোর্ট দেওয়া- এগুলো চিকিৎসা অবহেলার অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণসহ অনেক বিষয়ে ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিস্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অনেক দেশে টর্ট আইনে মামলা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের আদালত নেই। ফলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তি চেয়ে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে হয়। এ জন্য সুনির্দিষ্ট আইন নেই। ফলে কোন কোন কাজগুলো চিকিৎসায় অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে এবং অবহেলার প্রমাণ পেলে কখন দেওয়ানি বা কখন ফৌজদারি মামলা করা যাবে; কী পরিমাণ শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; সেসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। তবে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪ (এ) ধারামতে, কোনও ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিত কোনও কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটালে এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হলে; সেই ব্যক্তি অবহেলাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

এ জন্য তাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত যেকোনও মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদার মধ্যে ‘স্বাস্থ্য’ রয়েছে। ১৮ অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিমান এবং ‘গণস্বাস্থ্য’ সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২-এ বর্ণিত ‘জীবন রক্ষার অধিকার’ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এই অধিকার ক্ষুণ্ন হলে (চিকিৎসায় অবহেলা) সর্বোচ্চ আদালতে রিট বা জনস্বার্থে মামলা করা যাবে। ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি বাংলাদেশের প্রধান ফৌজদারি আইন। দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারানুযায়ী কোনও ব্যক্তি যদি বেপরোয়া বা অবহেলামূলক কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটায় তাহলে সেটি ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। দণ্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৪ ধারায় ডাক্তারি প্রয়োজন ব্যতীত গর্ভপাত ঘটানো একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ২৭৪, ২৭৫ ও ২৭৬ ধারায় যথাক্রমে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জামে ভেজাল মেশানো, ভেজাল ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি এবং এক ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্য নামে বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব অপরাধ দমনে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে আদালত পরিচালনা করা হয়। তবে একই দণ্ডবিধির ৯২ ধারা অনুসারে সরল বিশ্বাসে কোনও ব্যক্তির উপকার করার উদ্দেশ্যে চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা প্রদান করলে এবং এর ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১৯ ধারা অনুসারে কারও অবহেলাজনিত কাজের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্থানীয় দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুসারে কোনও রোগী ফির বিনিময়ে ডাক্তার, হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেবা গ্রহণ করলে তিনি ‘ভোক্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত অবহেলার শিকার হলে ভোক্তা অধিকার আইনে ক্ষতিপূরণ চেয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। এ তো গেলো আইনের কথা। সবাই নানা কারণে আইনের আশ্রয় নেন না; কিংবা নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু চিকিৎসককে সতর্ক করার জন্য রেটিং পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন, একজন চিকিৎসকের সনদের জন্য ১০ নম্বর থাকবে। তিনি প্রথমবার ভুল চিকিৎসা দিলে তার ২ নম্বর কাটা যাবে। দ্বিতীয়বার ভুল করলে কাটা যাবে ৩ নম্বর। তৃতীয়বার ভুল করলে কাটা যাবে ৪ নম্বর। এরপর আর তিনি রোগী দেখতে পারবেন না। তার সনদ বাতিল হয়ে যাবে। বিশ্বের অনেক দেশে এই প্রথা চালু আছে। আমাদের দেশে এটা চালু করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ।