স্বাস্থ্যের মর্যাদা ও ন্যায্যতা নারী ও কিশোরীর অধিকার

আমরা কি স্বাচ্ছন্দ্যে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলি? একটা সময় ছিল, যখন মাসিক নিয়ে কেউ মুখ খুলতেই চাইতো না। এটা পুরোপুরিই একটা লুকানো বিষয় ছিল, লজ্জা আর নানা কুসংস্কারে ঢাকা। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বিশ্বজুড়ে সবাই বুঝতে পারছে যে মাসিক শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপার নয়, এটা একটি অধিকার। আমাদের বাংলাদেশ, আমরা তো চাই একটা সমান অধিকারের দেশ গড়তে, তাই না? কিন্তু এই দেশের প্রত্যেক নারী এবং কিশোরীর জন্য এখনও কি মাসিক স্বাস্থ্য একটা চ্যালেঞ্জ নয়?

২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আর ইউনিসেফ (UNICEF) মিলে ‘মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ (MHM) নামে একটা নতুন ধারণা নিয়ে আসে। ২০২২ সালে মানবাধিকার কাউন্সিল মাসিক স্বাস্থ্যবিধি আর মাসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে একটা স্পষ্ট যোগসূত্রও তৈরি করে। এখন আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি যে মাসিকের শুধু শারীরিক দিকটাই নয়, এর মানসিক আর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিকগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য দরকার সঠিক তথ্য জানা, এই বিষয়ে শিক্ষা পাওয়া, মাসিক ব্যবহারের পণ্য হাতের কাছে পাওয়া, এর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন আর স্বাস্থ্যবিধি (WASH) পরিষেবা পাওয়া, এবং এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা যেখানে কোনও সংকোচ বা কোনোরূপ বৈষম্য থাকবে না। এমন একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে মাসিক নিয়ে কোনও কুসংস্কার বা খারাপ ধারণা থাকবে না, সবাই মাসিককে একটা স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া হিসেবেই নেবে।

মাসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন পাওয়া, নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচা, সুস্থ থাকা, শিক্ষা লাভ, সবার সমান অধিকার, যৌন ও প্রজনন অধিকার, কাজ করার অধিকার এবং সমাজের সব কাজে অংশ নেওয়ার মতো অনেক মানবাধিকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো পূরণ করতেও সরাসরি সাহায্য হবে। আমাদের সংবিধানেও লিঙ্গ সমতার (অনুচ্ছেদ ১৯(৩), ২৭, ২৮, ২৯) কথা বলা আছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫, ১৬, ১৮(১) আছে, কাউকে কোনও বৈষম্য না করার কথা (অনুচ্ছেদ ১২(ঘ), ২৮, ২৯(২), ৩৮(খ)) আছে। সবার অংশগ্রহণ আর সমাজের কাজে জড়িয়ে থাকার (অনুচ্ছেদ ১১, ১৯(৩), ২৩, ২৩এ, ৩৭, ৬৫(৩) কথাও আছে। এমনকি পরিবেশ রক্ষার (অনুচ্ছেদ ১৮এ) কথাও আমাদের সংবিধানে আছে।

আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি করে। তারাই মাসিক পণ্যগুলো সহজে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তার গুণগত মান কেমন, দাম কেমন, এসব বিষয়ে খেয়াল রাখে। অনেক সময় তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে কাজ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবার নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আর পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাসিক নিয়ে শিক্ষা আর সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে। আর গ্রামের উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পানি আর স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করে।

মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য কিন্তু নিরাপদ পানি, পরিষ্কার স্যানিটেশন আর স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা, আর ন্যায্য মূল্যে এবং যথাযথ মাসিক পণ্য পাওয়াটা খুব দরকার। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তো স্কুলেও মেয়ে আর ছেলেদের জন্য আলাদা WASH ব্লক (অর্থাৎ শৌচাগার, পানির ব্যবস্থা ইত্যাদি) নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। আরও কিছু নীতিমালা আছে, যেখানে বলা হয়েছে যে স্কুল আর পাবলিক প্লেসে সবার জন্য কম খরচে নিরাপদ পানি আর স্যানিটেশন সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে, এমনকি পাবলিক টয়লেটও এর আওতায় আসবে। MHM-কে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন সমাজে আর সংস্কৃতিতে এটা সহজে গ্রহণ করা হয়, আর এর সঙ্গে কোনও সংকোচ বা কুসংস্কার না থাকে। এই সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা এবং কৌশলপত্রসমূহে এমন স্যানিটেশন ব্যবস্থা তৈরি করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যেখানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিশ্চিত করা থাকবে।

সরকারি নির্দেশনায় মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য উন্নত, আলাদা টয়লেট বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে ময়লা ফেলার ঝুড়ি, সাবান আর মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পানির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আর একটা খুব দরকারি কথা রয়েছে এই নির্দেশনায়: নারী শিক্ষকদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে কথা বলতে হবে আর যথাযথ স্যানিটারি ন্যাপকিন যেন পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র ২০২১ বলছে যে বেশিরভাগ সরকারি অফিসে WASH সুবিধাগুলো নারীদের জন্য ঠিকমতো নেই—ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, সাবান নেই, ডাস্টবিন নেই, হাত ধোয়ারও ঠিকমতো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হলো কর্মক্ষেত্র, কারাগার, শিল্প প্রতিষ্ঠান আর বাণিজ্যিক জায়গাগুলোসহ সব জায়গায় MHM সুবিধাগুলো যেন সহজে পাওয়া যায়। জাতীয় কৌশলপত্রমতে স্কুলের সিলেবাসে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই, এমনকি যারা স্কুল ছেড়ে দিয়েছে, তাদের জন্যও। স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যেন MHM সুবিধাগুলো সহজে পাওয়া যায়, এবং তারা যেন ‘নারীবান্ধব ইউনিট’ হিসেবে সেবা দিতে পারে।

কিন্তু একটা বড় সমস্যা আছে, সেটা হলো মাসিক পণ্য আর স্যানিটেশন সুবিধার দাম। অর্থের অভাবে যেন কেউ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। মাসিক পণ্যগুলোকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’ হিসেবে ধরা উচিত, যাতে এর ওপর থেকে ভ্যাট বাদ যায় এবং এগুলো আরও সস্তা হয়। আমাদের দেশে মাসিক পণ্যের দাম কমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির কাঁচামালের ওপর কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল দাম কমানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু আসল কথা হলো, উৎপাদনকারীরা সেই সুবিধার কতটা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। অভিযোগ আছে যে এই কর কমানোর সুবিধা মূলত কিছু প্রভাবশালী কোম্পানিই বেশি পেয়েছে, আর এখনও ভ্যাট তো দিয়েই যাচ্ছি।

এখন প্রয়োজন একটি স্পষ্ট আইন, অবকাঠামোতে আর পণ্য পাওয়ার ব্যবস্থায় নিয়মিত বিনিয়োগ, ভালো মানের নিশ্চয়তা, আর সবার জন্য এই পরিষেবার প্রাপ্যতা। যদি আমরা মাসিক স্বাস্থ্যকে মর্যাদা আর ন্যায্যতার একটা মূল বিষয় হিসেবে দেখি, তাহলে বাংলাদেশ, সারা বিশ্বে—একটা দারুণ উদাহরণ তৈরি করতে পারবে।

লেখক: আইনজীবী এবং নীতি ও আইন গবেষক। সমন্বয়ক, মাসিক স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা (MHM) প্ল্যাটফর্ম।