এই দুই কৃষকের মতোই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরাঞ্চলের প্রায় সব কৃষকেরই একই অবস্থা। চলতি মাসে কয়েক দফা টানা বৃষ্টি আর আগাম পাহাড়ি ঢলে জেলার মেদির হাওর, উত্তর গাভের হাওর, পাতলপুর হাওর, লঙ্গণ হাওর ও বাগাইয়া হাওরে ভাটি অঞ্চলের কৃষকের একমাত্র ভরসা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। ভলাকুট গ্রামের কৃষক ময়দর আলী যেমন বলেন, ‘বানের পানি আমাদের শেষ কইরা দিছে।’
কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলোতে দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল আর বাঁধের ভাঙনে ফসল হারিয়ে এখন দিশেহারা এসব অঞ্চলের কৃষক। শুধু তাই নয়, মড়ক লেগেছে হাওরের মাছেও। আর এসব এলাকায় দফায় দফায় ধান-চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়ায় কৃষকরা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন।
এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা গরু-ছাগলও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এসব পশুর দামও পাচ্ছেন না তারা। নেত্রকোনার কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাল-ডালসহ সব জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা গরু-ছাগল বিক্রি করতে গেলে দাম পাচ্ছি না। আমরা এখন কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’
এ বছর অতিবৃষ্টি ও আগাম বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। বাংলা ট্রিবিউনের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি হিমাদ্রি শেখর ভদ্র জানিয়েছেন, জেলার দেড় লাখ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে এক লাখ ৬০ হাজার কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষিকাজ ছাড়া হাওর এলাকায় বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান না থাকায় অসময়ে ফসল হারিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। ৯০ ভাগ কৃষকের ঘরে নেই খাবার।
সুনামগঞ্জ খামারবাড়ি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়েছিল। দেড় লাখ জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৪জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া, গত কয়েকদিনে হাওরে ২৫ মেট্রিক টন দেশীয় মাছ মারা গেছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অফিস। এর বাজারমূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
তবে সুনামগঞ্জ পাউবো বলছে, এ বছর আগাম বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় এবং হাওর এলাকার নদী খনন না করায় বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকেছে। গত মার্চ মাসে হাওরের পানির বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণেই বাঁধের ডিজাইন ফেল করে বাঁধ ভেঙে গেছে।
বাংলা ট্রিবিউনের কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি বিজয় রায় খোকা জানিয়েছেন, গত দুই দিন নতুন করে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় হাওর এলাকার সব নদ-নদীর পানি এখনও বাড়ছে। এতে আরও প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলার কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অকাল বন্যায় এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। নিরুপায় কৃষকরা পানির নিচ থেকে তুলে আনছেন নষ্ট হয়ে যাওয়া আধা-পাকা ধান।
জেলার মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের চেয়াম্যান নুরুল হক বাচ্চু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোপদিঘীর সর্বশেষ সিংগা বাঁধটিও ভেঙে গেছে। যে সামান্য জমি প্লাবিত হওয়া বাকি ছিল, তাও রক্ষা করা গেল না। সরকারের দেওয়া সামান্য ত্রাণ সহায়তা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এবারের মতো অবস্থা কখনই হয়নি। কৃষককে বাঁচাতে হলে এবার সব ঋণ মওকুফের ব্যাবস্থা করতে হবে।’
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম।
আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, চলমান অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলার ১২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলার হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সোনাদিঘি, কাওয়াদিঘির হাওর ও কইরকোনা বিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজার ২৭৬ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বোরো চাষীদের ক্ষয়ক্ষতি ১২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা নিরুপণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে তাদের সহযোগিতার চেষ্টা চলছে।’
শুধু ধানই নয়, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় হাকালুকি হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছও মরে যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ মাছ মারা গেছে, এর কোনও হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।
বাংলা ট্রিবিউনের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি মোহাম্মদ নূর উদ্দিন জানিয়েছেন, অকাল বন্যা, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার গুঙ্গিয়াজুরি হাওর, গণকির হাওর, ভরগাও হাওর, কালুয়ার বিল, খাগাউড়া হাওরসহসহ অধিকাংশ জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এতে ডুবে গেছে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমির ধান। আবারও বন্যার কবল থেকে বাঁচতে কৃষকরা জমি থেকে আধা-পাকা ধান কেটে নিয়ে আসছেন।
জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। সরকাররিভাবে যতটা সম্ভব সহায়তা করা হবে কৃষকদের।
বাংলা ট্রিবিউনের নেত্রকোনা প্রতিনিধি হানিফ উল্লাহ আকাশ জানিয়েছেন, জেলার ৪৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি অধিদফতর। এতে নষ্ট হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৩২ মেট্রিক টন ধান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৪৭০টি কৃষক পরিবার। ক্ষতির নগদ আর্থিক মূল্য প্রায় ৭শ ৩৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এছাড়া, স্থানীয় মৎস ব্ভিাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর এ জেলার হাওর থেকে সাতশ কোটিরও বেশি টাকার মাছ আহরণ করা হয়। কিন্তু এ বছরে হাওরগুলোতে মাছ মরে ভেসে উঠছে। ফলে জেলার মৎসজীবীরাও পড়েছেন বিপাকে।
/বিএল/টিআর/