উজানের ঢলে ভেসে গেছে কৃষকের স্বপ্ন, এখন শুধুই হাহাকার

2

দিন ১৫ আগেও হাওর জুড়ে ছিল ধানের খেত। ফলনও ভালো হয়েছিল, তাই খুশিই ছিলেন কৃষকরা। ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তারা। হঠাৎই উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় কৃষষের খেত। সেই সঙ্গে ভেসে যায় স্বপ্ন। একের পর এক বাঁধ ভেঙে আর ভারী বর্ষণের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন হাওরবাসী। ফসল তোলা তো দূরের কথা বেঁচে থাকতেই এখন নিরন্তন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

হাওরে যতদূর চোখ যায় শুধু অথৈ পানির খেলা। সেই পানির নিচেই পড়ে আছে কৃষকের সোনালী ফসল। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পাশাপাশি বোঝা হয়ে দাড়িয়ে আছে মহাজন ও এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ। বুক ভরা কষ্ট আর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের পানে। এছাড়া আর কী বা করার আছে তাদের।

নিজেদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সঙ্গে যোগ হয়েছে গবাদি পশুর রক্ষা। প্রথমে নষ্ট হওয়া ধানের অংশ বিশেষ গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন তারও উপায় নেই। অব্যাহত বৃষ্টির কারণে পানির নিচে তলিয়ে গেছে ধান। ফলে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। রোদ না থাকায় পচতে শুরু করেছে পানি থেকে তুলে আনা আধা পাকা ধান।

3

ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ষাটর্ধ্বো কৃষক রইছ আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দশ কানি জমিতে বোরো আবাদ করছিলাম বাজান। এখন সবডাই আমার পানির নিচে। কেমনে বাঁচমু, কি খায়া বাঁচমু, আর কেমনেই বা মহাজনের ধার দেনা দিমু। এখন তো পরিবার নিয়া মরণ ছাড়া উপায় নাই।’

অষ্টগ্রাম উপজেলার আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের কৃষক রমজান আলী বলেন, ‘অভাবের সংসারে বছরে একটা ফসলের দিকেই চাইয়া থাকি। ভালা ফলন হইলে বছরের বাকি দিনডি কোনোরকমে যায়। কিন্তু এমন অইবো হেইডা তো বুঝতে পারি নাই। অল্প জমাইন্যা টেহা আর এনজিও থেইক্যা ঋণ নিয়া জমি চাষ করছি। এহন তো আমি জিন্দা লাশরে বাবা। কেরা দেখব আমরারে!’

মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী ইউনিয়নের সর্বহারা এক কৃষকের স্ত্রী জামিলা খাতুন বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমরার অহন কিতা অইব। অত দেনা লইয়্যা জমিজামা কইরা এহন তো মরার পথে। অভাবের সংসারে কেমনে চলব, আর কেমনে দেনা দিয়াম?’

4 (1)

এত প্রতিকূলতার মধ্যেই আশার কথা শোনালেন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস। হাওরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, হাওর বেষ্টিত অঞ্চল ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, তাড়াইল, হোসেনপুর, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে অকাল বন্যার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতায় তারা টিম গঠন করেছেন। হাওরের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জরুরি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তালিকা তৈরি করে সময় মতো ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাওরের পানিতে কোনও প্রকার ক্ষতিকারক ভাইরাসের প্রভাব রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়েছে।  কিশোরগঞ্জের হাওরের পানিতে এমন কোনও পদার্থের উপাদান পাওয়া যায়নি যার ফলে হাওরের মাছ বা গবাদি পশুর ক্ষতি হতে পারে।

কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, তাড়াইল, হোসেনপুর, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে এ বছর ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ দুর্যোগে কৃষকের আবাদকৃত ধানের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর। টাকার হিসেবে যা প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও নিকলীতে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

1

জেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবারের মদ্যে ৫৩৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৮ লাথ ৬০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের খাদ্য, জীবিকা ও আগামী মৌসুমে কৃষি কাজের সব ব্যবস্থা করবে সরকার। এমনকি জরুরি ত্রাণ পর্যায়ক্রমে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে দুর্যোগকালীন তিনমাস নিয়মিত ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ৩০ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। এছাড়া আরও এক লাখ কৃষক পরিবারকে ওএমএস-এর আওতায় এনে সহযোগিতা করতে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে।

ঋণের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হাওর অঞ্চলে যেসব এনজিও বা মহাজনরা কৃষকদের ঋণ দিয়েছে তাদেরকে আপাতত কৃষি ঋণ আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 /এসটি/

আরও পড়ুন: নদীতে পানি বাড়ায় আতঙ্কে কাঁচা-পাকা ধান কাটছেন নাটোরের কৃষকরা