গাইবান্ধায় নদ–নদীর পানি বাড়ছে, দেখা দিয়েছে ভাঙন

পানি বাড়ছে, বাড়ছে বন্যার আতঙ্ক (ছবি- প্রতিনিধি)

বৃষ্টি ও উজানের ঢলে গাইবান্ধার সবক’টি নদ–নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে জেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষেরা বন্যার আশঙ্কা করছেন; একইসঙ্গে তারা বসতবাড়ি ও আবাদি জমি তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কেও ভুগছেন। এদিকে, তিস্তা, ব্রক্ষপুত্র ও যুমনা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছেন, নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে অনেক আবাদি জমি ও স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেললেও স্থায়ী কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা, সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় যমুনা, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া এবং সদর ও সাদুল্যাপুর উপজেলায় ঘাঘট নদীর পানি বাড়ছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনও বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে নদ-নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিস্তার ভাঙনে সুন্দরগঞ্জ, ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে সদরের কামারজানি, যমুনার ভাঙনে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বেশ কিছু এলাকার বসতবাড়ি নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে। এতে নদী পাড়ের মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

বন্যার আতঙ্কে রয়েছে এসব মানুষ (ছবি- প্রতিনিধি)

কামারজানির গোঘাট গ্রামের বাসিন্দা প্রতাপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘গত ১০ দিনে ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে অর্ধ-শতাধিক কাঁচা-পাকা বসতভিটে তলিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে গাছপালা, ফসলি জমি, মসজিদ, মন্দির।’

জাহিদুল ইসলাম নামে অন্য এক ব্যক্তি বলেন, ‘ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে এখন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে কামারজানি বাজার, ইউপি ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ওয়াবদা বাঁধ ও একটি সুইস গেট। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছে রাস্তা ও অন্যের জমিতে। কিন্তু ভাঙনরোধে কোনও স্থায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।’

শিল্পী রাণী দাস নামে এক নারী বলেন, ‘নদী ভাঙনে সব হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। অসুস্থ স্বামী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনোরকমে অন্যের জমিতে ঘর তুলে বাস করছি। কিন্তু আয় না থাকায় খাবার জুটছে না। এভাবে এক সপ্তাহ ধরে কষ্টে দিন কাটালেও কোনও ত্রাণ মেলেনি।’

তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে একজনের ভিটেমাটি (ছবি- প্রতিনিধি)

স্থানীয়রা জানান, ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে প্রতিদিনই ভিটেমাটি হারাচ্ছেন তারা। অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন উচু জায়গা ও অন্যের জমিতে। অনেকে আবার শেষ সম্বল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কাজ না থাকায় ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষই খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছে।

সমাজকর্মী সাদ্দাম হোসেন পবন বলেন, ‘কামারজানি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশপাশের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে ভাঙনের শিকার শত শত পরিবার। নিঃস্ব ও কর্মহীন এসব মানুষ খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।’ এসব মানুষকে সরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়াসহ নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের কামারজানি, সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, চন্ডিপুর, লালচামারের ঘাট, কাপাসিয়া ও বেলকা, সাঘাটার হলদিয়া, জুম্মারবাড়ি, ভরতখালি এবং ফুলছড়ির ফজলুপুর, উড়িয়া, রতনপুর ও সিংড়িয়াসহ বেশ কিছু গ্রামের মানুষ নদী ভাঙনে আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছেন। এসব এলাকার অন্তত একহাজার বসতবাড়ি, অনেক গাছপালা ও ফসলি জমি ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনাও।

ভাঙনরোধে ফেলা হচ্ছে বালুর বস্তা (ছবি- প্রতিনিধি)

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এটিএম রেজাউর রহমান বলেন, ‘শুকনো মৌসুমে ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এরপর ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়। কিছু প্রকল্পের অনুমোদন পাওয়ায় বেশ কিছু এলাকায় ভাঙনরোধে কাজ চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে পানি বাড়ায় কিছু এলাকায় ভাঙন বেড়েছে। জরুরি প্রকল্পের আওতায় ভাঙন-কবলিত এলাকায় বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া, সদরের কামারজানি এলাকায় ব্রক্ষপুত্রের ভাঙন ঠেকাতেও বালুর বস্তা ফেলার কাজ চলছে। তবে এসব এলাকার ভাঙনরোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কোনও বরাদ্দ নেই। তবে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে বেশ কয়েকটি প্রকল্প তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।’

জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ পাল বলেন, ‘নদ-নদীর পানি বাড়লেও এখনও কোনও গ্রাম প্লাবিত হয়নি। তবে পানি আরও বাড়লে নিম্নাঞ্চলে কিছু মানুষ পানিবন্দি হবে। বন্যা মোকাবেলা ও বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যথেষ্ট সরকারি ত্রাণ মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া, নদী ভাঙন ঠেকাতে ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন এলাকায় কাজ শুরু করেছে। নদী ভাঙনের শিকার মানুষকে সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তালিকা করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের হাতে ত্রাণ পৌছে দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে ভাঙনের শিকার মানুষের পুর্নবাসনের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।’