শ্রীপুরে স্পিনিং কারখানায় আগুনে নিহতদের পরিবারগুলো দিশেহারা

আগুনে নিহত ছয়জন গাজীপুরের শ্রীপুরে স্পিনিং কারখানায় ভয়াবহ আগুনে নিহতদের পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ওই পরিবারগুলোতে এখন চলছে আর্তনাদ আর শোকের মাতম। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কেউ রেখে গেছেন সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। কেউবা শিশুসন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে। একদিকে স্বজন হারানোর গভীর শোক, অন্যদিকে পরিবারের ভরণ-পোষণের কী ব্যবস্থা হবে এই চিন্তায় নিহতদের পরিবারগুলো এখন দিশেহারা। 

বুধবার (৩ জুলাই) পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে এ ঘটনায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন− ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার উলুন গ্রামের আলাল উদ্দিনের ছেলে রাসেল (৪৫), শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ ধনুয়া গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৩২), গাজীপুর গ্রামের মো. হাসেন আলীর ছেলে শাহ জালাল (২৫), কালিয়াকৈর উপজেলার মৃত শামসুল হকের ছেলে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার সেলিম কবির (৪২), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ভুবনকোড়া গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আবীর রায়হান (২১) ও পাবনা জেলার আমীনপুর উপজেলার মৃত কেরামত সর্দারের ছেলে সুজন (৩০)।

নিহতদের কয়েকজনের পরিবারের বিষয়ে খোঁজখবর জানতে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধি কথা বলেন স্বজনদের সঙ্গে।   

সুজনের পরিবারের সামনে অন্ধকার

সেদির আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান পাবনার আমিনপুর উপজেলার নান্দিয়ারা গ্রামের মৃত কেরামত আলীর ছেলে সুজন (৩০)। তিনি ওই কারখানার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র দেখাশুনা করতেন। আগুনের খবর শুনে তার মামাতো ভাই কামরুল হাসান মঙ্গলবার তাকে কারখানায় খুঁজতে আসেন।

তিনি বলেন, ‘দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সুজন (৩০) সবার বড়। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবাহারা পরিবারে সুজনই একমাত্র উপার্জনক্ষম। স্ত্রী ও পাঁচ মাসের এক শিশুসন্তান রয়েছে তার। বাড়িতে রয়েছেন মা, এক ভাই ও স্কুল পড়ুয়া এক বোন। বছর পাঁচেক আগে তার বাবা মারা যান। মা’সহ তিন সদস্যের পরিবারে উপার্জনক্ষম এখন আর কেউ থাকল না। এখন অন্ধকার পথের যাত্রী হয়ে রইল পরিবারের সদস্যরা।’

সুজনের সহকর্মী রতন শেখ বলেন, ‘আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যারা মারা গেছেন তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। তাদের মধ্যে চারজনই ছিলেন কারখানার এসি শাখায়। তারা আগুন নেভাতে চেয়েছিলেন। সুজনকে বলেছিলাম বেরিয়ে যেতে। তিনি চেয়েছিলেন আগুন নেভাতে। কিন্তু আগুনের তীব্রতায় তিনি দগ্ধ হন।’

ভস্মীভূত কারখানামোটরসাইকেলের চাবির রিং দেখে দেহ শনাক্ত

শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর গ্রামের আবুল হাসেনের ছেলে শাহ জালাল (২৫) কারখানার কোয়ালিটি শাখায় কাজ করতেন। তার মামা আবদুল খালেক বলেন, ‘ভাগনের মরদেহ এমনভাবে পুড়ে গেছে যে দেখে শনাক্ত করার উপায় ছিল না। পকেটে থাকা মোটরসাইকেলের চাবির রিং দেখে তার দেহ শনাক্ত করেছি। গত তিন মাস আগে প্রতিবেশী এক মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কাবিন হয়েছে। কিছুদিন পরই বিয়ের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা করার কথা ছিল। কিন্তু সে শুভক্ষণ তার জীবনে এলো না।’

ভাই হারানো শোকের সঙ্গে সংসারের সব ভার এখন রাসেলের ওপর

সুজনের অপর সহকর্মী আবীর রায়হান (২১)। তিনি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার ভুবনকোড়া গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে মেজো। ছোট ভাই আবু তোরাব উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তার বড় ভাই আবু রাসেল বলেন, ‘বাবা-মা’র অভাব ছোট দুই ভাইকে কখনও বুঝতে দিইনি। আমরা দুটি ভাই পরিশ্রম করে সংসার চালিয়েছি। এখন সংসারের সব ভার বহন করতে হবে আমাকে। তবে এখন ভাইয়ের মৃত্যুর ভার বহন করা আমার জন্য হবে সবচেয়ে কঠিন।’

কারখানার বাইরে অপেক্ষমাণ উদ্বিগ্ন স্বজনরাআগুনের মধ্যে দৌড়ে ঢুকতে যান স্ত্রী

সেদিন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার সেলিম কবির (৩৫) মারা যান। দগ্ধ হওয়ার খবর শুনে তার স্ত্রী সখিনা বারবার আগুনের মধ্যে দৌড়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেছেন। অন্য স্বজনরা বাধা ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। জ্ঞান হারিয়ে সজ্ঞা ফিরে পেয়ে আবার আগুনে ঢুকতে উদ্যত হচ্ছিলেন। তিনি বুধবার পর্যন্ত বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। সখিনার ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সংসার জীবনে তাদের নয় বছর বয়সী সাবিদ হাসান ও পাঁচ মাসের সাজিদ হাসান নামে দুটি ছেলে রয়েছে।’

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুর সোয়া ২টার দিকে শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকার অটো স্পিনিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কারখানার ব্যাক প্রসেসিং ইউনিটে (তুলা উৎপাদনের প্রাথমিক ইউনিট) আগুনের সূত্রপাত হয় ও পরে তা বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ২২ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহীনুর ইসলামকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শাহীনুর ইসলাম বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আগুন লাগার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান, ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিতকরণ, ক্ষয়-ক্ষতির নিরূপণ এবং এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সুপারিশমালা প্রদান করবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে।’

 আরও পড়ুন: গাজীপুরে অটো স্পিনিং মিলে আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, নিরাপত্তাকর্মী নিহত