বাবলু মাসে ৬০০ টাকা ভাড়ায় চায়ের দোকান চালান। ১৭ বছর ধরে মামলা চালাতে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের খরচ জোগান দিতে পারেননি তিনি। তাই তার স্ত্রী মিনু বেগম মানুষের বাড়িতে এবং বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। বাধ্য হয়েই অল্প বয়সেই তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে তামিম আর স্ত্রীসহ তিনজনের সংসার চালাতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন বাবলু।
বাবলু বলেন, ‘বিনা দোষে ১৭ বছর আদালত, থানা আর উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে আমি সবদিক দিয়ে শেষ হয়েছি। টাকা গেছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করেছি। আত্মীয়-স্বজনরা সহায়তা করতে করতে বিরক্ত হয়ে এক সময় এড়িয়ে চলেছে। দেখেছি আপন মানুষদের অবহেলা। এখন মামলা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো একটু শান্তিতে কাটাতে চাই। ক্ষতিপূরণ পেলে ঋণ পরিশোধ করা সুবিধা হবে। কিন্তু তার জন্য কোনোভাবেই আদালতে যেতে চাই না।’
তবে তাকে যারা অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেল খাটিয়েছেন এবং ১৭ বছর ভুগিয়েছেন তাদের শাস্তি দাবি করেছেন।
সরেজমিনে আঁচল কোট গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র দুই কাঠা জমির ওপর বাবলু শেখের বাড়ি। জীর্ণশীর্ণ বাড়িটিই দারিদ্রতা প্রকাশ করছে। বাবলু শেখের স্ত্রী মিনু ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় মাটিকাটার কাজ করছেন। আর বাবলু ও তার ছেলে চা দোকানে কাজ করছেন। ১৭ বছর পর বাবা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার খবরে বাড়ি এসেছে তার তিন মেয়ে। এই প্রতিবেদক পৌঁছানোর প্রায় এক ঘণ্টা পর বাড়ি আসেন মিনু। তিনি জানান সংসারের অবস্থা সম্পর্কে।
তিনি জানান, স্বামীর জামিন এবং আদালতে অন্যদের দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করাতে গিয়ে যে ঋণ হয় তা শোধ করে সংসার চালাতে হিমশিম খান তার স্বামী। দিনের পর দিন ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। এর ওপর প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দেওয়া, উকিলের টাকা গোছানো আর তদন্তে আসা পুলিশদের টাকা দিতে গিয়ে অধিকাংশ দিনই অর্ধাহারে-অনাহারে সংসার চলত তার।
মিনু বলেন, ‘খরচ চালাতে না পেরে পঞ্চম শ্রেণিতেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় বড় মেয়ে লাবনীর। মেজো মেয়ে টপি লম্বা-চওড়া হওয়ায় লেখাপড়া করিয়ে প্রশাসন বা অন্য কোনও চাকরি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর টাকার তার পড়ালেখাও বন্ধ করে দেই।’
মামলা চালানোর জন্য বাবলু-মিনু দম্পতি চারটি সমিতির কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই টাকার জন্য প্রতি মাসে কিস্তি দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় কর্মসৃজন প্রকল্পে মাটিকাটার কাজ করেন মিনু। এছাড়া দিনমজুর ও মানুষের বাড়িতে থালা বাসন মাজার কাজ করেন তিনি। আর বাবলু ভাড়ার চা দোকান চালান। দু’জনে মিলে প্রতি মাসে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালিয়ে ঋণের কিস্তি দিতে পারছেন না। তিন মেয়ের লেখাপড়া না হলেও একমাত্র ছেলে তামিমকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছেন তারা। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে সংসার চালানোর পর ছেলেরে লিখাপড়া চালাতে পারবেন কিনা তা নিয়েই পড়েছেন শঙ্কায়।
এক প্রশ্নের জবাবে মিনু বলেন, ‘মিথ্যা মামলায় পড়ে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ চাই।’ তবে আদালতে আর যেতে রাজি নন তারা। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের পদক্ষেপ পেলে তারা উপকৃত হবেন।
জেলা পুলিশ সুপার লিটন সাহা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান এবং জেলা বারের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, বাবলু শেখের রায়ের কপি তাদের কাছে পাঠানোর নির্দেশনার বিষয়টি তারা শুনেছেন। এখনও পর্যন্ত কপি তারা পাননি। কপি হাতে পাওয়ার পর আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করবেন তারা।
প্রসঙ্গত, দুই তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) ভুলে দুই দফায় দুই মাস ১০ দিন কারাভোগ ও ১৭ বছর আদালতে ঘুরে আপিলের রায়ে খালাস পান দিনমজুর বাবলু শেখ। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে নাটোর জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সিদ্দিক এই দিনমজুরকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন। একইসঙ্গে এমন ভুলের জন্য সংশ্লিষ্ট দুই তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন আদালত।
আরও পড়ুন:
১৭ বছর পর মুক্তি পেলেন আরেক ‘জাহালম’