ঋণের টাকায় শ্রমিকদের অগ্রিম বেতন




এএমসি নিট কম্পোজিট লিমিটেডকরোনা পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা এখনও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ কারখানাই শ্রমিকদের মার্চের বেতন এখনও শোধ করতে পারেনি। এ অবস্থাতেও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে গাজীপুর সদর উপজেলার বানিয়ারাচালা (মেম্বারবাড়ি) এলাকার এএমসি নিট কম্পোজিট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতনের সঙ্গে দিয়েছে এপ্রিল মাসের অগ্রিম বেতন। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে পোশাক কারখানাটির কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

এসপি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) সুবল চন্দ্র সাহা এসব তথ্য জানিয়েছেন। শ্রমিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার কারখানায় বর্তমানে তিন হাজার ৩০০ শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের অবদানেই আমার আজকের অবস্থান। তাই করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে তারা সংকটে থাকবে, এটা মেনে নিতে পারিনি। শ্রমিকদের হাতে টাকা নেই। বাসা ভাড়া ও দোকান বকেয়ার টাকা দিয়েই তাদের মার্চের বেতন খরচ হয়ে যাবে। কারখানা বন্ধ থাকায় তাদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। এ অবস্থায় সার্বিক বিষয় চিন্তা করে দেখলাম এপ্রিলের বেতনটা হাতে থাকলে তারা সংকটে পড়বেন না।

‘তাই হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকার পরেও বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের দুই মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছি’- যোগ করেন তিনি।

কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়ে সুবল সাহা বলেন, কারখানার মালিক নয়, একজন নাগরিক হিসেবে শ্রমিকদের দুর্ভোগ আমাকে ব্যথিত করেছে। হাজার হাজার শ্রমিক রোদে পুড়ে হেঁটে কর্মস্থলে ফিরেছেন। পরদিন আবার তারা দলে দলে বাড়ি ফিরে গেছেন। আমি করোনাভাইরাসের ভয়ে দিনের পর দিন কারখানায় যাইনি। এ অবস্থায় শ্রমিকদের কেমন করে কাজে আসতে বলি?

এদিকে অগ্রিম বেতন পেয়ে খুশি কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা। সুইং সুপারভাইজার নওগাঁ সদর উপজেলার দশপাইকা গ্রামের রাজু আহম্মেদ বলেন, আমি ১২ বছর ধরে এ কারখানায় চাকরি করছি। অপারেটর থেকে এখন সুপারভাইজার হয়েছি। আমাদের স্যার (মালিক) এপ্রিল মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে বাবার পরিচয় দিয়েছেন। এ যুগে একজন বাবাও তার ছেলেকে কাজ ছাড়া টাকা দিতে চান না। আমরা অনেক খুশি হয়েছি। তাছাড়া এ কারখানায় যখন-তখন ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতির কোনও ভয় নেই।

সুইং শাখার নারী সুপারভাইজার ময়মনসিংহের পারভীন আক্তার বলেন, আমি এ কারখানায় ৫-৬ বছর ধরে চাকরি করছি। আমাদের স্যার (মালিক) যে কাজ করেছেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট। স্যার করোনাভাইরাস থেকে যেন মুক্ত থাকতে পারি এবং চলতি মাসের চলার (খরচ) কথা চিন্তা করে আমাদের এপ্রিল মাসের বেতনও দিয়ে দিয়েছেন। এতে কারখানার শ্রমিকদের চাকরি নিয়েও কোনও টেনশনে থাকতে হবে না।

কারখানার কাটিং অপারেটর ময়মনসিংহের তারাকান্দা থানার মেঘাহালা গ্রামের তৈয়ব আলী জানান, কারখানার বন্ধের দিন (২৫ মার্চ) মালিক আমাদের দুই মাসের (মার্চ ও এপ্রিল) বেতন একসঙ্গে দিয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। কারখানার স্যারেরা আমাদের নিয়ে অনেক সচেতন।

বানিয়ারাচালা এলাকার সবিনয় রাইস এজেন্সির (চালের দোকান) মালিক সাহাব উদ্দিন জানান, কারখানাটি (এএমসি নিট কম্পোজিট লিমিটেড) সবসময় শ্রমিদের কথা চিন্তা করে। দুই মাসের বেতন দিয়ে দেওয়ায় শ্রমিকেরা আমাদের বকেয়া পরিশোধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি তারা নগদ টাকা দিয়ে আগামী মাসের চালও কিনে নিয়েছে। আর তখনই জানতে পারলাম মালিক তাদের চলতি (এপ্রিল) মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৩ মার্চ থেকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে তখন তা আমলে নেননি তৈরি পোশাক কারখানার অনেক মালিক। ২৫ মার্চ পোশাক কারখানাগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ঘোষণা করেন। এরপর তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ তাদের সদস্যদের প্রতি কারখানা বন্ধের অনুরোধ জানায়। সে অনুযায়ী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ ছিল। তবে এই সাধারণ ছুটির মধ্যেই ৫ এপ্রিল কারখানা চালুর ঘোষণা দেন অনেক মালিক। এ অবস্থায় গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরেও করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়েই পায়ে হেঁটে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর কারখানায় পৌঁছান শ্রমিকরা। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে শেষ পর্যন্ত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।