বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতিঅতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে অবনতি হয়েছে বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতির। অন্যদিকে বৃষ্টিপাত কিছুটা কমায়, অনেক এলাকার পানি কিছুটা নেমেছে। তবে বেড়েছে পানিবাহিত রোগ। খাবার ও গোখাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় বেড়েছে জনদুর্ভোগ।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, যমুনার পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি ৮ সেন্টিমিটার বেড়ে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) আব্দুল মান্নান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর, দুরমুঠ, নাংলা, কুলিয়া, ফুলকোচা ও ঝাউগড়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সবমিলিয়ে জেলার ৩৮টি ইউনিয়ন ও ৫টি পৌরসভার আড়াই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সড়কে পানি ওঠায় দুর্গত এলাকায় ব্যহত হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ।

দুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো.আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে পাট, আমনের বীজতলা, আউশ ধান, সবজির জমিসহ অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল।

জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতিজামালপুরের সিভিল সার্জন ডা. প্রণয় কান্তি দাস জানান, জেলার বন্যা দুর্গত এলাকায় ৮০টি মেডিক্যাল টিম কাজ করে যাচ্ছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী জানান, জেলার ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকা ও ৬০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, উজানের ঢলে যমুনার পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জে পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী একেএম রফিকুল ইসলাম জানান, যমুনার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭ সে.মিটার বেড়ে মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় বিপদসীমার (১৩ দশমিক৩৫) ৪৫ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পাউবোর পূর্বাভাস দফতরের তথ্যানুযায়ী যমুনায় পানি আরও বাড়াতে পারে।

সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিসিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বিকালে জানান, যমুনার পানি বাড়লেও এখনও জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে আগামীতে গোখাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। পানিতে বীজতলা ও সবজির জমি ডুবে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কায় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে এক হাজার মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২০ লাখ টাকা এবং শিশু ও গোখাদ্যের জন্য আরও ১০ লাখ টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

এদিকে, পানি বাড়ার সঙ্গে সদরের কাওখোলা ইউনিয়নের বড় কয়রা, বেড়াবাড়ি, বর্ণি এবং কাজিপুর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও চৌহালী উপজেলার যমুনা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের বাড়িঘর ও কৃষিজমি প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজারও মানুষ।

সিরাজগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতিসুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় জেলায় বন্যার পানি কমছে, তবে হাওর এলাকায় বাড়ছে মানুষের র্দুভোগ। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার উঁচু এলাকাগুলো থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনও শান্তিবাগ, মরাটিলা, নুতনপাড়া, নবীনগর, ষোলঘর, কালীপুর, মল্লিকপুর, ওয়েজখালী, হাছনবসত, সুলতানপুর মোহাম্মদপুর, বনানীপাড়া, কলেজ রোড, পশ্চিমহাজীপাড়া, বড়পাড়া, তেঘরিয়া, জেলরোড, লঞ্চঘাটসহ অনেক আবাসিক এলাকার সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এসব এলাকার সড়কে নৌকা দিয়ে লোকজন শহরে আসা-যাওয়া করছেন। পৌর এলাকার ৬০ ভাগ ঘরবাড়ি ও আঙ্গিনায় এখনও বন্যার পানি রয়ে গেছে। নিচু এলাকার নলকূপগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট। সুনামগঞ্জ শহরের প্রতিটি সড়কে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ।

স্থানীয়রা জানান, ঢলের পানি ও প্রবল স্রোতে রাতে গ্রামীণ সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দেওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। হাওর বেষ্টিত সদর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা, শাল্লা, ছাতকসহ ৯টি উপজেলার কয়েক হাজার বসতবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। দুর্গত এলাকার লোকজন গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। বসত বাড়ির আঙিনায় বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় খড়ের খাদা পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে। এতে গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া গরুর ঘর পানিতে নিমজ্জিত থাকায় গবাদি পশুর বাসস্থানেরও সংকট দেখা দিয়েছে।

সুরমায় ঢলের পানিতে প্লাবিত নিম্নাঞ্চলজেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা যায়, সদরের ৯টি, বিশ্বম্ভরপুরের পাঁচটি, তাহিরপুরের সাতটি, জামালগঞ্জের চারটি, ছাতকের পাঁচটি, শাল্লার একটি, দোয়ারাবাজারের দুটি, জগন্নাথপুরের তিনটি ও ধর্মপাশা উপজেলার চারটি ইউনিয়নসহ ৬১টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছেন। সদরের ১১টি, বিশ্বম্ভরপুরে আটটি, তাহিরপুরে ৩১টি, জামালগঞ্জে ২৫টি, ছাতকে তিনটি, দোয়ারাবাজারে তিনটি, শাল্লায় একটি, ধর্মপাশায় ২০টি ও জগন্নাথপুর উপজেলায় দুটি ও চারটি ছাতক, সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুরসহ চারটি পৌরসভায় ২৩টিসহ মোট ১২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজার ১৯৪টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। ৯টি উপজেলা ও চারটি পৌরসভায় ৬৬ হাজার ৮৬৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৪১০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, দিয়াশলাই, মোমবাতি, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।

বন্যায় নলকূপ ডুবে যাওয়ায় সুনামগঞ্জে বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুবর রহমান বলেন, সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বর্ষণের কোনও সম্ভাবনা নেই। নদীর পানি দ্রুত কমে যাচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, জেলার ৯টি উপজেলার ২৫ হাজার গবাদি পশু গোখাদ্য সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে ধর্মপাশা ও দোয়ারাবাজার উপজেলায়। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, বন্যার কারণে ৯টি উপজেলার তিন হাজার নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকায় নলকূপের ভেতরে বন্যার পানি ঢুকে গেছে। সেগুলোকে জীবাণুমুক্তকরণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া প্লাবিত এলাকায় দুই লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।

সুরমার পানিতে ডুবেছে রাস্তা-ঘাট
সড়ক জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, বন্যায় জামালগঞ্জ- সুনামগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ দোয়ারাবাজারের সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কে অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কগুলোর কোনও কোনও অংশ ভেঙে পড়েছে। এছাড়া জেলার ২৫ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সিভিল সার্জন মো. শামছ উদ্দিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের জন্য মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়া অব্যহত রয়েছে। ত্রাণের কোনও সংকট নেই। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শুকনো খাবার ও শিশু খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ জুন) তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি পরিমাপ করে এই ফল পাওয়া গেছে। ওই পয়েন্টে বিপদসীমা (৫২ দশমিক ৬০) সেন্টিমিটার। এর আগে গত শুক্রবার ওই পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং তা অব্যাহত থাকে রবিবার পর্যন্ত। সোমবার (২৯ জুন) সকালে পানি কমতে শুরু করলে সেদিন বেলা তিনটায় বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানিডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গত সোমবার সকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।’

এদিকে বন্যায় জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদী বেষ্টিত প্রায় ১৫ গ্রামের তিন হাজার ২২০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া খগাখড়িবাড়ি ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নে ৬৯ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে।

উপজেলার টেপাখড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ময়নুল হক বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৭০০ পরিবারের জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। বুধবার (১ জুলাই) থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে মধ্যে ১৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।’

ডিমলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রাণী রায় বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ১২৫ মেট্রিক টন চাল ও দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।’ ত্রাণ তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের বিতরণ চলছে বলে জানান তিনি।