জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগে রয়েছে বানভাসিরা। সোমবার (৬ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ২৭ সেন্টিমিটার কমে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদ-নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাইদ এবং পানি মাপক গেজ পাঠক আব্দুল মান্নান।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেলার সাতটি উপজেলার ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৪৯টি ইউনিয়নে প্রায় তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৯ জন পানিবন্দি। তারা এখন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যায় জেলার সাতটি উপজেলার ১৩ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও এখনও হাওর এলাকায় বন্যার পানি রয়ে গেছে। সদর উপজেলার গৌররাং ইউনিয়নের ভাটিশাফেলা, পিয়ারিনগর ও ঢুলপুশি এলাকায় গোয়ালঘর তলিয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা গবাদিপশুকে উঁচু সড়ক ও সেতুতে অস্থায়ী শেড বানিয়ে রেখেছেন। তবে গ্রামের লোকজনের যাতায়াতের সড়কগুলো এখনও পানিতে ডুবে আছে।
বন্যায় হাওর এলাকার ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাওর এলাকার বাড়িঘরের রাস্তা এখনও পানির নিচে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকায় ধীরগতিতে কমছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি। এরমধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর ঘাঘট নদীর পানি কমে এখন বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে সাত দিন ধরে জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের পানিবন্দি প্রায় অর্ধলাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখনও পানিতে তলিয়ে আছে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক, হাট-বাজার ও স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সোমবার (৬ জুলাই) গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়েছে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া করতোয়া নদীর কাটাখালি পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নদ-নদীর পানি আরও কমবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত সাত দিনে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার অন্তত ১০টি পয়েন্টে শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া যমুনার গর্ভে হারিয়েছে সাঘাটা উপজেলার ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি। পাশাপাশি এসব এলাকায় ভাঙনের হুমকি মুখে পড়েছে আরও দুই শতাধিক বাড়িঘর।
জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সম্প্রতি বন্যা আর নদীভাঙনের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজারের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের জন্য এ পর্যন্ত ২০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন। দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য ৬১টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বন্যা কবলিত এলাকার ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে না যাওয়ায় দুর্ভোগ কমেনি বানভাসিদের। অপ্রতুল ত্রাণ সহায়তায় দুর্গত এলাকায় খাদ্য সংকট রয়েছে। অন্যদিকে ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকা পরিবারগুলো পাকা সড়ক, বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকায় চলছে গো-খাদ্যের সংকট। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে থাকায় এখনও অনেক এলাকায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এছাড়া বন্যা পরিস্থিতিতে কাজের সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবীদের তিন বেলা খাবার জোটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরের বাসিন্দা আমির হামজা জানান, বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও কাজ জুটছে না। তাই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।
দুর্গত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানান, চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি থেকে পানি নামতে শুরু করলেও এখনও অনেক ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম মধ্য জুলাইয়ের দিকে আবারও বন্যার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ৯ তারিখের পর আবারও পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভাঙন দেখা দেওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে পাবনার সুজানগর, বেড়া ও ঈশ্বরদী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম। পদ্মা নদীর তীরবর্তী সাতবাড়িয়া, গুপিনপুর, ভাটপাড়া, মাজপাড়া, মালিফা, মালফিয়া, ইন্দ্রজিৎপুর, উদয়পুর, নাজিরগঞ্জের বাসিন্দাদের কৃষি জমি ও বসতবাড়ি নদীতে তলিয়ে গেছে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন জানায়, শনিবার থেকে কমতে শুরু করেছে পদ্মা নদীর পানি। সকালে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি রবিবারের তুলনায় ০.০১ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ২.২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত শুক্রবার যা ছিল ২.২৯ সেন্টিমিটার।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, কমতে শুরু করেছে যমুনা নদীর পানি। শুক্রবার ও শনিবার একই অবস্থায় ছিল যমুনা নদীর পানি। শনিবার সকালে যমুনা নদীর পানি নগরবাড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবারও ছিল একই অবস্থায়। আজ সোমবার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি কমতে থাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে নদী পাড়ের মানুষদের মাঝে। তবে পানি কমতে থাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ভাঙন কবলিত মানুষের কৃষি জমি ও বসতবাড়ি।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, ডালিয়া পয়েন্টে সোমবার (৬ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপদসীমার (৫২. ০৭) ৫৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। ওই পয়েন্টে বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। তবে রবিবার (৫ জুলাই) ওই পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়েছিল। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন জানান, উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়নের ১৫টি চর ও চর গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। তবে নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ৭৯টি পরিবার।
তিনি আরও জানান, নাউতারা নদীর ৬টি পয়েন্টে ভাঙনের কারণে ৫০ বিঘা আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও এলাকাবাসীর চলাচলের জন্য নদীর ওপর একটি কাঠের সাঁকো পানির তোড়ে ভেসে গেছে। তলিয়েছে ব্যাপক ফসলি জমি ও বীজতলা। অসংখ্য পুকুর থেকে ভেসে গেছে লাখো টাকার মাছ। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি আরও বলেন, বন্যার পানি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট খুলে রাখা হয়েছে।
গত ১৮ বছরে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে মাত্র দু’বার। ২০০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মা বিপদসীমা অতিক্রম করেছিল। ওই বছর পদ্মার পানির উচ্চতা দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ৭০ মিটার।
এদিকে নগরীর বহরমপুর ও পবার পদ্মাপাড় এলাকা ও খাল-বিল ঘুরে দেখা যায়, মাছ ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। তবে ঘোলাটে পানির কারণে কাঙ্ক্ষিত মাছ পাচ্ছেন না বলে জানান তারা। পানি কমতে শুরু করলে ভালো মাছ পাবেন, এমন প্রত্যাশা তাদের।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি ঘটলেও ধরলা ও তিস্তার পানি কমার সঙ্গে নদীভাঙনও তীব্র হয়েছে। গত ১০-১২ দিনে লালমনিরহাটের সদর উপজেলায় ৬৮ পরিবার ও হাতীবান্ধায় ৯ পরিবার নদীভাঙনের ফলে গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
সোমবার (৬ জুলাই) পর্যন্ত লালমনিরহাটে নদীভাঙনে ৭৭ পরিবার গৃহহীন ও বন্যায় ১০ হাজার ৮১০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের জন্য ১২৩ দশমিক ৪৮০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ ১৫ লাখ ২৫ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ ছাড় করা হয়েছে। এসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। লালমনিরহাট সদর ও হাতীবান্ধা উপজেলার ৭৭টি পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। নদীভাঙনের শিকার প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৭ হাজার টাকা ও ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার ৮১০ পরিবারকে তালিকা অনুযায়ী ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।