টাঙ্গাইলের মধুপুরে বনবিভাগের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযানে ৪০ শতাংশ জমির কলাগাছ কাটাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এ ঘটনায় মানববন্ধন, বন কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও ও ভাঙচুরের ঘটনা দেখা গেছে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পেগামারি গ্রামে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নারী বাসন্তী রেমার জমির পাঁচ শতাধিক কলাগাছ কেটে ফেলে বনবিভাগ। তার তোলা কলাবাগান উজাড়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে সমালোচনা চলছে।
বাসন্তী রেমার দাবি– বংশপরম্পরায় পাওয়া জমিতে কলাবাগান গড়েছিলেন। কিন্তু বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে কলাচাষি শহিদ আলীর নাম। শোলাকুড়ি ফকিরাকুড়ি গ্রামের এই ভ্যানচালকের দাবি– বাসন্তী রেমার কাছ থেকে ৪০ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে তিনিই কলাবাগানটি করেছেন।
বাসন্তী রেমা বলেন, ‘বংশপরম্পরায় জমিটি ভোগ করে আসছি। প্রায় সাত মাস আগে এখানে কলার আবাদ করি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর কোনও নোটিশ না দিয়েই বনবিভাগের লোকজন আমার পাঁচ শতাধিক কলাগাছ কেটে ফেলেছে। ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কলাগাছের চারা রোপণ করেছিলাম। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
জমির কাগজের ব্যাপারে বাসন্তী রেমার স্বামীর মুখে শোনা গেলো, ‘পূর্বপুরুষের আমল থেকেই জমিটি আমরা ভোগ করে আসছি। এমনিতে তেমন কাগজপত্র নেই। পূর্বপুরুষরা কী যেন একটা কাগজ জমা দিয়ে জমি ভোগ করে আসছিল। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা তো পূর্বপুরুষ থেকেই সরকারি জায়গায় ঘরবাড়ি করে থাকে।’
শহিদ আলীর দাবি, “৫৩০টি কলাগাছের চারায় এ পর্যন্ত আমার ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। আমি গরিব মানুষ, এখন অসহায় হয়ে বাড়িতে বসে আছি। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেছেন– ‘এটা বনবিভাগ দেখবে। তুমি চিন্তা কইরো না।’ আমি সেই ভরসাতেই ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। তবে এ নিয়ে যে মানববন্ধন হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। বাসন্তী রেমাও আমাকে জানায়নি।”
স্থানীয় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বাসিন্দারা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে উল্লেখ করেন, ‘আমাদের মা-বাবারা পাহাড়-জঙ্গলে বসবাস করে ফসল আবাদ করে চলতো। কিন্তু গাছগাছালি নষ্ট করতো না। গজারি গাছগুলো ঠিকভাবেই থাকতো। এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু সরকার এভাবে জমি কেড়ে নেবে আমরা ধারণা করি নাই। এসব জমি আমাদের জমি, দখলের জমি। জমি তো এখন রেকর্ডের চেয়েও পুরনো হয়ে গেছে।’
সৌন্দর্যবর্ধন ও বনভূমি রক্ষায় নিয়মিত জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে বনবিভাগ। বাসন্তী রেমার কথিত জমিতে রোপণ করা কলাবাগান কেটে ফেলার ঘটনার সুযোগ নিয়ে জমি দখলদার ও প্রভাবশালী মহল বনবিভাগের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে।
আব্দুল আহাদের অভিযোগ, ‘অভিযানের সময় বাসন্তী রেমার লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তারা। আমার বাসা ও সরকারি মোটরসাইকেলে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। পরে পুলিশ গিয়ে আমাদের উদ্ধার করে।’
রেঞ্জ কর্মকর্তার তথ্যানুযায়ী, দোখলা রেঞ্জে বনভূমি ১৯ হাজার ৮৩৪ একর। জবরদখলে আছে ১২ হাজার ৪১১ একর। গত একবছরে ১৫৮ একর জমি বনভূমি জবরদখলমুক্ত করা হয়েছে। আব্দুল আহাদ বলেন, ‘যথারীতি সামাজিক বনায়ন সৃজন করেছি এবং উপকারভোগী নির্বাচন করে তাদের কাছে চুক্তিনামা হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
বনবিভাগ যেন অভিযান অব্যাহত রাখতে না পারে সেজন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রেঞ্জ কর্মকর্তার। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সামনে রেখে অন্যান্য জবরদখলকারী ও প্রভাবশালীরা আমাদের হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু যত প্রভাবশালীই হোক, আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যাবো।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তার মন্তব্য, ‘মধুপুরে বিশাল অংশ জবরদখল আছে। সেগুলো দখলমুক্ত করতে হবে। এখন পর্যন্ত টাঙ্গাইল বনবিভাগের প্রায় ৩৯ হাজার একর বনভূমি জবরদখলে আছে। এর মধ্যে মধুপুরে ১৪-১৫ হাজার একর জমি জবরদখল রয়েছে।’