সুনামগঞ্জ
গত কয়েক দিনের বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা, রক্তি, খাসিয়ামারা, চলতি নদীসহ সবক’টি নদীর পানি বাড়ছে। শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরের পর থেকে সুরমা নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে নদী তীরবর্তী এলাকার গ্রামগুলো।
এদিকে সদর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার উপজেলার আমন চাষিরা জানান, আজ সকালে থেকে তাদের রোপা আমনের ক্ষেত পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে গেছে। দ্রুত পানি সরে না গেলে রোপা আমন ক্ষেত পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে।
তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর এবং সুনামগঞ্জ-সাচনা সড়কের নিচু ও ভাঙা অংশ দিয়ে ঢলের পানি উপচে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এর আগে পর পর তিন দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়ায় সহজেই ঢলের পানি সড়ক উপচে হাওরে প্রবেশ করছে। ফলে তলিয়ে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৪২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই নদীগুলো দিয়ে ঢলের পানি প্রবেশ করছে। সুরমা নদীর পানি আজ সন্ধ্যা ৬টায় বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ৩ ঘণ্টায় ৪ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। এছাড়া সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের আমন চাষি আব্দুল ওয়াহিদ বলেন, ‘শুক্রবার সকাল থেকে আমাদের এলাকার জমিতে নদীর পানি প্রবেশ করছে। দুপুরের মধ্যেই পুরো জমি পানিতে ডুবে যায়। এখন জমিতে পানি আর পানি, এছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।’
রাধানগর গ্রামের জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এর আগে পর পর তিনবার বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এরপরও চাষিরা ধার-দেনা করে জমিতে রোপা আমন বুনেছিলেন। এখন চতুর্থবারের মতো আমাদের জমি পানিতে ডুবে গেছে।'
লালপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এখনও কোনও কৃষক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। চতুর্থবারের মতো আমন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন জমি নষ্ট হয়ে গেলে আর চাষাবাদ করার সময় বা সামর্থ্য কোনও কিছুই আমাদের নাই।’
জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ শুক্রবার বিকালে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে জানান, পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়ে। যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের প্রস্তুতি রয়েছে।
নীলফামারী
উজানের পানি প্রবাহ কমার কারণে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ পাঠক (পানি পরিমাপক) মো. নুরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তবে বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে একই পয়েন্ট দিয়ে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এ সময় ভয়াবহ ঢলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তিস্তা পাড়ের মানুষ।
পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী (পানি শাখা) মো. আমিনুর রশিদ জানান, ভারতের পাহাড়ি ঢল ও উজানের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি ওঠা-নামায় ডালিয়া পয়েন্টে বন্যা দেখা দেয়।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উজানের পানি প্রবাহ একটু কমে আসায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিপৎসীমার (৫২ দশমিক ৬০) ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহ হয়েছে।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ওই পয়েন্টে সকাল ৯টায় পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার নিচে নামলেও বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪ স্লুইস গেট (জলকপাট) খুলে রাখা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম
বৃষ্টি আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর অববাহিকায় আবারও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি তীব্র নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক পরিবারসহ আবাদি জমি ও বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনকবলিত কিছু এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও হিমশিম খাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
পাউবো জানায়, শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুর ৩টায় সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য নদ-নদীর পানি বাড়লেও শুক্রবার বিকাল থেকে সামান্য কমতে শুরু করেছে।
জেলার নদ-নদীর অববাহিকা অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। জেলার সদর উপজেলায় ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, নাগেশ্বরীতে দুধকুমার, রৌমারী ও রাজীবপুরে ব্রহ্মপুত্র এবং উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলায় তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ফসলি জমি হারানোর পাশাপাশি বসতভিটা হারাচ্ছেন নদী অববাহিকার বাসিন্দারা। গত কয়েক সপ্তাহে উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, বজরা ও থেতরাই ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙনে পাকা সড়ক, ফসলি জমি ও মসজিদসহ ভিটেমাটি হারিয়েছেন শতাধিক পরিবার। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে আরও শতাধিক পরিবারসহ সড়ক ও ফসলি জমি। এ উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বাস্তুহারা হচ্ছেন শত শত পরিবার।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে গত দুই দিনে অন্তত ১৫টি পরিবার ভিটেহারা হয়েছে বলে জানান ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার। ভাঙন কবলিতদের পুনর্বাসনে একাধিকবার তালিকা পাঠানো হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান।
আইয়ুব আলী সরকার বলেন, ‘ধরলার পানি তীব্র বেগে প্রবেশ করায় গত দুই দিনে ইউনিয়নের গারুহারা গ্রামে অন্তত ১০/১৫টি পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। এছাড়াও খাসেরচর ও চরভগবতীপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শুক্রবার পঞ্চম দফায় ভাঙনে ভিটেহারা ৩৫ পরিবারের তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসনে এ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
এদিকে নদ-নদীতে পানি বাড়ায় তলিয়ে গেছে কয়েকশ’ হেক্টর আমন ও সবজি ক্ষেত। দ্রুত পানি সরে না গেলে এসব জমির ফসল পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকরা।
সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের কৃষক শামসুল হক জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বন্যা শুরু হয়েছে। কয়েকদফা রোপা আমন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পর আবারও তলিয়ে যাওয়ায় নতুন করে আর আমন লাগানো সম্ভব হবে না। এবার আমনে কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তোলা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, নদী ভাঙনে ভিটেহারাদের তালিকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়ামাত্র ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা হবে। তবে দুর্গতদের খাদ্য সহায়তা চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শনে কুড়িগ্রামে এসেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তিনি শুক্রবার বিকালে জেলার সদর উপজেলার মোঘলবাসা ইউনিয়নে ধরলার বামতীরসহ উলিপুর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
লালমনিরহাট
লালমনিরহাটে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৩টার পরেও বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল তিস্তা নদীর পানি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে তিস্তায় আকস্মিক পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। এ কারণে তিস্তা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, বুধবার বিকাল তিনটায় বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানিপ্রবাহ ছিল কিন্তু একইদিন সন্ধ্যায় হঠাৎই তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সন্ধ্যায় পানিপ্রবাহ বেড়ে রাত ১২টায় বিপদসীমার ৫২ দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার পর থেকে পানিপ্রবাহ কমতে শুরু করে। এরপরও বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় ১৫ সেন্টিমিটার পানিপ্রবাহ কমে বিপৎসীমার ৫২ দশমিক ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী এএসএম আমিনুর রশীদ।
তিনি আরও বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর অঞ্চলে গত এক সপ্তাহ থেকে ভারী বৃষ্টিপাতে নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে তিস্তা নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ কারণে জনজীবনে কিছুটা দুর্ভোগ বেড়েছে।'
গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিপাতে শাকসবজি ক্ষেত ও বীজতলার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, 'কৃষির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের জন্য মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তথ্য আসার পর বিস্তারিত জানানো হবে।'
হাতীবান্ধা উপজেলার গোড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামল বলেন, ‘হঠাৎ তিস্তায় বন্যা দেখা দেওয়ায় অনেক মানুষের বাড়ী পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।'
এদিকে, এ আকস্মিক বন্যায় কবলিতদের সুরক্ষায় জেলা প্রশাসন থেকে ১১৫ মে.টন জিআর চাল ও ৮১০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যা কবলিতদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। তিনি নিজে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের চরগোবর্ধন ও আশেপাশের দুর্গত এলাকাগুলোতে বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এসময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় লোকজনকে কোমর পানি ভেঙে সরকারি ত্রাণসামগ্রী নিতে দেখা গেছে।