এই দিনে লাল-সবুজের পতাকা উড়েছিল যেসব জেলায়

গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস


১৯৭১ সালের এই দিনে হোপালগঞ্জ,  মাগুরা ও নোয়াখালী জেলা পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিদেনটি করা হলো।


গোপালগঞ্জ
আজ সোমবার, ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ শহর হানাদার মুক্ত হয়। গোপালগঞ্জ মুক্ত হওয়ার আগে এই অঞ্চলে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মুখ যুদ্ধ হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদাররা গোপালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মিনি ক্যান্টনমেন্টে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করে গণ-কবর দেয়। ৬ ডিসেম্বর সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের দিকে আসে। পাকিস্তানি সেনাদের আস্তানায় চারিদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বলয় রচিত হয়।  গভীর রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানা, উপজেলা পরিষদ (বর্তমানে) সংলগ্ন জয় বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধারা। সেই সঙ্গে মুক্ত হয় গোপালগঞ্জ শহর ও এর আশপাশ এলাকা। 

প্রতিবছর দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হলেও এবছর করোনার কারণে জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সীমিত আকারে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

আজ ভোর ৭টায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বদ্ধভূমিতে শহীদদের স্মরণে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়েছে। বেলা ১১টায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সভাকক্ষে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর। 
জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, করোনায় সব সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। তাই ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবসের কর্মসূচিও সীমিত করে শুধু শহীদদের স্মরণে পুষ্পমাল্য অর্পণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।  

মাগুরায় স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ

মাগুরা 

৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এদিন মাগুরা পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়।
মাগুরার মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন মাগুরা ও ঝিনাইদহ মহকুমার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ফরিদপুর জেলার একটি অংশকে শত্রুমুক্ত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যশোর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি অংশ তাড়া খেয়ে মাগুরায় পালিয়ে আসে। এক পর্যায়ে মাগুরায়ও তারা তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মাগুরার মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রবল আক্রমণে শত্রুবাহিনীকে মাগুরা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মাগুরা ত্যাগ করে ফরিদপুরের কামারখালী অভিমুখে চলে যেতে বাধ্য হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় আকবর হোসেন মিয়া এবং মোল্লা নবুয়ত আলীর নেতৃত্বে শ্রীপুর বাহিনী মাগুরায় প্রবেশ করে প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করে।

বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের মাগুরা ত্যাগ করলে স্বাধীনতাকামী জনতার মাঝে স্বস্তি আর শান্তি ফিরে আসে। এ সময় মুক্তিপাগল জনতা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এভাবেই ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মাগুরা হানাদার মুক্ত হয়।’
মাগুরা মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মাগুরা জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তযোদ্ধা সংসদ, মাগুরা পৌরসভাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিনভর কর্মসূচির পালন করবে। যার মধ্যে রয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা, লাঠি খেলা, সন্ধ্যায় ব্ল্যাক আউটের মাধ্যমে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল  আলম বলেন,  ‘এবার মাগুরা মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে সবই এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠিত হবে।’

 নোয়াখালীতে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ

নোয়াখালী
‘৭১ সালের এই দিনে নোয়াখালী মুক্ত হয়। এদিন জেলা শহর মাইজদী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এ রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি দখলের মধ্য দিয়ে নোয়াখালীর মাটিকে মুক্ত করে লাল সবুজের বিজয় নিশান উড়িয়েছিল মুক্তিসেনারা।

৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানিরা। এসময় বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করতেই সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর হামলায় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া মারা যায়।
মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তযুদ্ধকালীন সি-জোন কমান্ডার এবং বর্তমান সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের জেলা সাধারণ সম্পাদক মোশারেফ হোসেন বলেন, ৭ ডিসেম্বর ভোররাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত অপারেশন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সব মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে চারদিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা সংলগ্ন টেকনিক্যাল হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প মুক্ত করে এবং একই দিন জেলা শহর মাইজদি বাজার ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, নাহার মঞ্জিল, রৌশনবাণী সিনেমা হল, দত্তেরহাট ও সোনাপুর কোল্ড স্টোরেজের রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে মুক্তিকামী জনতা। শহরের কোর্ট বিল্ডিং এ উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা।
নোয়াখালী মুক্ত দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিরন বলেন, দিবসটি উপলক্ষে ৭ ডিসেম্বর মাইজদি পিটিআই সংলগ্ন মুক্ত স্কয়ারে বিকাল ৩ টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। 

সাতক্ষীরা

আজ ৭ ডিসেম্বর, সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৬টি যুদ্ধ জয়ের পর এদিন সাতক্ষীরার মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসতেই পিছু হটে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে সাতক্ষীরার ডাকবাংলোয় ঘাঁটি করা জঙ্গি পাকিস্তানি সেনাদের। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহিত খান দুলুর নেতৃত্বে ধুলিহর বেজেরডাঙ্গা থেকে একটি দল এবং ক্যাপ্টেন হুদা ও আবদুল্লাহর নেতৃত্বে আরও দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে শত্রু বাহিনী বেনেরপোতা ও বেত্রাবতী ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পিছু হটে যায়। বীর যোদ্ধারা সাতক্ষীরা থানা ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ঘোষণা দেন সাতক্ষীরা মুক্ত দিবসের। নানা আয়োজন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে পালিত হবে সাতক্ষীরামুক্ত দিবস।
৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাতিস্তানি সেনাদের। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা। পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানে সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা। 

শেরপুর

৭ ডিসেম্বর শেরপুর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহায়তায়  মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুর অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত করেন। এইদিন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে হাজারো জনতার এক স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশে  শেরপুরকে মুক্ত বলে ঘোষণা দেন। সেইসঙ্গে  তিনি মুক্ত শেরপুরে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পাতাকা উত্তোলন করেন।
শেরপুর সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান তালাফতুপ হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৩০-৪০টি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থানে গড়ে তোলা ঘাটিতে  চলে তাদের  নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এসব ঘাটিতে রাজাকার, আলবদর আর দালালদের যোগসাজসে হানাদাররা চালাতে থাকে নরহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের নৃশংস ঘটনা। ১১ নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের বেশ ক’বার কামালপুর দুর্গে আক্রমণ চালান। ১১ দিন অবরোধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর এ ঘাটির পতন হয়। জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়  দিবস উদযাপিত হলেও এই দিনটি শেরপুর জেলা বাসীর জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।


শেরপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে শুক্রবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে  জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ।

বাগেরহাট
৭ ডিসেম্বর মোংলা ও সুন্দরবন এলাকা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে এ এলাকা শক্রু মুক্ত করেন।
মোংলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার শেখ আব্দুর রহমান জানান, ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিন আহমদ এবং কবির আহমেদ মধুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার মোংলা ও সুন্দরবন এলাকা সম্পূর্ণভাবে শক্রু মুক্ত করেছিলেন। বিশেষ করে সুন্দরবনে স্থাপিত ৫টি ক্যাম্পে সেনা কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধায়নে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আর সুবিধা মতো সেখান থেকে আক্রমণ করা হতো মোংলা, রামপাল, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পগুলোয়। দীর্ঘকাল পরে হলেও মোংলা পোর্ট পৌরসভার পক্ষ থেকে পৌর পার্ক এলাকায় নির্মিত হয়েছে একটি যুদ্ধ জাহাজ সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য।