পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখান থেকে প্রতিদিন জেলার এক একটি এলাকায় হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ, নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালাতো। এছাড়া, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী, আত্মীয়স্বজন ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে চালানো হতো বর্বর নির্যাতন। তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখা হতো বর্তমান উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকা ও পুকুর পাড়ে। ফলে এটি গোপালগঞ্জের অন্যতম বধ্যভূমিতে পরিণত হয়।
সে সময় এই অঞ্চলের পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফয়েজ মোহাম্মদ ও সেলিমের নেতৃত্বে পাকিস্তানি জল্লাদরা বর্তমান জেলা সদরের ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টে কসাইখানা তৈরি করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। এ টর্চার সেলে নির্যাতনে শহীদ হওয়া ৪৫ জনের নাম জানা গেলেও শহীদদের সঠিক সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে মিত্র দেশ ভারত প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করায় হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। এদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলেছে এমন খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা গোপালগঞ্জের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। মেজর সেলিমের অধীনে হানাদার বাহিনীর একটি দল চলে যায় রাজধানী ঢাকার দিকে। অন্য একটি দল চলে যায় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ার ওয়ারলেস ক্যাম্পে।
অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে গোপালগঞ্জ সদরের আকাশে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা। শহীদদের রক্ত আর বীর মুক্তিযোদ্ধারে সাহসী যুদ্ধে শক্রমুক্ত হয় গোপালগঞ্জ।
গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা বদরুদ্দোজা বদর বলেন, ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর স্বজনদের খোঁজে মুক্তিকামী মানুষ ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টে যান। সেখানে ইটের স্তূপের মধ্যে, সামনের খোলা জায়গায় অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড় ও নারীদের মাথার চুল দেখতে পেয়ে স্বজন হারানোর বেদনায় আপ্লুত হয়ে পড়েন।
ক্যাম্প অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফয়েজ মোহাম্মদ ও সেলিমের কক্ষে মহিলাদের অসংখ্য হাতের চুড়ি, শাঁখা, গলার চেইন, শাড়ি, ব্লাউজ পড়ে ছিল। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীতে জেলেদের জালে দীর্ঘদিন মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল জড়িয়ে পড়তো। স্বজন হারানো মানুষ এখনও বধ্যভূমির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে নীরবে চোখের জল ফেলেন।