মাগুরায় চার খুন

পুনরায় হামলা-লুটপাটের আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছেন তারা

চার খুনের ঘটনায় মাগুরার জগদল এখন আতঙ্কের জনপদ। হামলা-লুটপাট আর গ্রেফতার আতঙ্কে নারী-পুরুষরা গ্রাম ছাড়ছেন। প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে জগদালের মাঝিপাড়া।

আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জগদল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এতে মেম্বার প্রার্থী হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার বিকালে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন চার জন।

সেই রোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জগদল গ্রামের শিউলি ও শাবানা বলেন, ‘হামলাকারীরা ধারালো রামদা দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে প্রতিপক্ষের লোকদের। একের পর এক আঘাতে রক্তাক্ত রহমান ও কবির এক পর্যায়ে হামলাকারীদের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানায়। কিন্তু হামলাকারীদের হৃদয়ে সেই আকুতি সামান্যতম রেখাপাত করেনি। হামলাকারীরা লাথি দিয়ে রহমান ও কবিরসহ অনেককেই ফেলে দেয় পার্শ্ববতী পুকুরে। পুকুরে ফেলে দেওয়ার পর তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে আবার নতুন করে শুরু হয় হামলা। অন্যদিকে রামদার আঘাতে মৃতপ্রায় সবুর মোল্লা পানি পানি বলে কাতরাতে থাকেন। প্রত্যক্ষদর্শী নারীরা পানি নিয়ে এগিয়ে গেলে তাদের প্রতি উদ্ধত হয়ে ওঠে হামলাকারীরা।’

নিহত কবিরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে চাঁদনী আক্তার বলেন, ‘আমার বাবা মানুষের বিপদ-আপদের কথা শুনলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যেতেন। বাবার চাচাতো ভাইকে মারা হচ্ছে এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ছুটে যান তাকে উদ্ধার করতে। ভাইকে উদ্ধার করতে যাওয়া মাত্রই হামলাকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার ওপর। হামলাকারীদের নৃশংসতায় আমার বাবাও ফিরলো লাশ হয়ে।’

জগদল এখন আতঙ্কের জনপদনিহত সবুরের ভাই হাবিবুর বলেন, ‘এবার দুর্বৃত্তরা একই সঙ্গে হত্যা করলো আমার দুই ভাইসহ চার জনকে। এর আগেও এই দুর্বৃত্তরাই ২০০৩ সালে আমার আরেক ভাই জরিপ মোল্লাকে হত্যা করে। প্রভাবশালীদের চাপে আমরা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হই। জরিপ ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার হলে আবারও দুই ভাইকে হারাতাম না। জানি না এবারও ন্যায়বিচার পাবো কিনা?’

অন্যদিকে, চার খুনের ঘটনায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে জগদল গ্রামে। বাড়ির আসবাবপত্র ধান, চাল, গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাচ্ছেন গ্রামের নারী-পুরুষ। জগদাল গ্রামের মো. সুমনের স্ত্রী-সন্তানকে দেখা গেলো তল্পি-তল্পাসহ গ্রাম ত্যাগ করতে। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীসহ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা গতকালই বাড়ি ছেড়েছে। আমি মেয়ে মানুষ। বাড়িতে একা অবস্থান করায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। অন্যদিকে, পুনরায় হামলা ও লুটতরাজের ভয়ে আসবাপত্র চাল-ডাল নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করছি।’

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র নাঈমকে দেখা গেলো, ভ্যানে করে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গ্রাম ছাড়তে। জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমার বাবা-মা গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি ছেড়েছেন। আমি একাই বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। বাবা কিছুক্ষণ আগে ফোন করে চাল-ডাল, আসবাবপত্র, গবাদিপশুসহ আমাকে নানাবাড়িতে যেতে বলেছে। আমি ছোট মানুষ, এত কিছু নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চাল-ডাল, গবাদিপশু ফেলে রেখে শুধু কিছু আসবাবপত্র নিয়ে আমি নানাবাড়িতে যাচ্ছি।’

মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসান বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসবাদের জন্য চার জনকে আটক করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। শুধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরই গ্রেফতার করা হবে।’

উল্লেখ্য, আগামী ১১ নভেম্বর জগদল ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে জগদল ৩নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার নজরুল ইসলাম প্রার্থী হবেন। একই সঙ্গে সৈয়দ হাসানও ওই ওয়ার্ডে মেম্বার প্রার্থী। প্রার্থিতা নিয়েই নজরুল ও হাসানের সমর্থকদের মধ্যে শুক্রবার বিকালে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে চার জন নিহত এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।

আরও খবর: মাগুরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে নিহত ৪