সৌন্দর্য হারাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শশীলজ

কালের হাওয়ায় ময়মনসিংহের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শশীলজ এখন হারিয়েছে তার সৌন্দর্য। শ্বেতপাথরে তৈরি নারী মূর্তি অতীতের সুন্দর সময়ের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার নিচে ভাঙনের রেখা অনেকটাই স্পষ্ট। অযত্ন আর অবহেলায় খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। নান্দনিক কারুকার্য করা কাঠের ফ্রেমের ভেতর রঙিন কাচের দরজায় আঁকা ফুল-পাখি-নদী, পালতোলা নৌকাসহ আবহমান বাংলার প্রকৃতির ছবিও এখন বিবর্ণ। লোপাট হয়েছে বাড়ির মেঝেতে বসানো মূল্যবান শ্বেতপাথর এবং দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতির নানা অংশ। স্থানীয়দের দাবি, জেলার ঐতিহাসিক এ স্থাপনার সংস্কার করে যেন দর্শনার্থীদের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়।

ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার মহারাজ শশীকান্ত আচার্যের বসতবাড়ি ছিল এই শশীলজ। ২০১৩ সালে গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা) কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শশীলজের স্থাপনাসহ সব সম্পত্তি বুঝে নেয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মূল বাড়ির দখল নিলেও ২৩ কক্ষের মধ্যে মাত্র তিনটি ব্যবহার করে তারা জাদুঘর পরিচালনা করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, উঁচু সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা ৯ একর জমির ওপর শশীলজের প্রধান ফটক পেরোতেই মূল ভবনের সামনে বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে স্নানরত স্বল্পবসনা একটি নারী মূর্তি। বলা হয়ে থাকে, এত বড় মার্বেল পাথরের মূর্তি দেশে আর কোথাও নেই! তবে দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলায় এর নিচের অংশে ফাটল ধরেছে। পলেস্তারা খসে পড়ছে। সর্বগ্রাসী কাল হরণ করেছে এর সৌন্দর্য। শেওলাযুক্ত জল শ্বেতপাথরের দ্যুতিকে ঢেকে দিচ্ছে। একই অবস্থা বাড়ির ভেতরে ও বাইরে।

Mymensing Lead 3

প্রধান ফটক আর নারী মূর্তি পেরিয়ে শশীলজের ভেতরে ঢুকতে চোখে পড়বে বাড়ির মেঝেজুড়ে কেবলই শ্বেতপাথর। করিডোর, ডাইনিং, ড্রয়িং, হলরুম ও শোবার ঘর। সবখানেই বসানো হয়েছে মূল্যবান এই পাথর। বিদেশ থেকে আনা নামীদামী ঝাড়বাতিগুলো সোজা ওপর থেকে নেমে ঝুলে রয়েছে।

শশীলজের দুপাশে বিশাল দুটি শোবার ঘর। এর একটিতে রাজা, আরেকটিতে থাকতেন রানি। ফোয়ারা পেরিয়ে মাঝখানে বিশাল জায়গার ড্রয়িং ও ডাইনিং কক্ষ এবং হলরুম। তিনটি কক্ষের মধ্যে মাঝখানের কক্ষটি কেবল দৃষ্টিনন্দই নয়, আলিশান বলতে যা বোঝায়। এটিতে ঝোলানো রয়েছে বিদেশ থেকে আনা নামীদামী বাতির বিশাল ঝাড়। এই কক্ষের দুই পাশে আলাদা ঝাড়ে ঝুলছে আরও বাতির দুই গুচ্ছ কাচের রঙিন ঝাড়। এই কক্ষের দুই পাশে আরও যে দুটি কক্ষ রয়েছে তাতেও শোভা পাচ্ছে এ রকম নজরকাড়া ঝাড়বাতির গুচ্ছ। তবে এসব ঝাড়বাতির সব কটিই এখন অচল ও ভাঙাচোরা। প্রতিটি কক্ষেই চমৎকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রয়েছে। ড্রয়িং, ডাইনিং ও হলরুমের প্রতিটিতে এক ডজনের মতো করে কারুকার্য করা কাঠের দরজা। কাঠের ফ্রেমের ভেতর রঙিন কাচ পার্টিশান করে লাগানো। তাতে শোভা পাচ্ছে ফুল, পাখি, নদী, পাল, তোলা নৌকা, বক, রাজহাঁস, পেখম তোলা ময়ূর, শান্তির প্রতীক পায়রাসহ প্রকৃতি-আবহমান বাংলার ছবি। প্রতিটি কাঠের ফ্রেমের দরজার ভেতর রঙিন ও সাদা কাচে দুর্লভ এসব চিত্রকর্ম আকা রয়েছে নিখুঁতভাবে।

কিন্তু এসব সৌন্দর্য উপকরণে এখন অযত্ন ও অবহেলায় ছাপ স্পষ্ট। বেশ কয়েকটি কক্ষের মেঝে থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে শ্বেতপাথর। এর বাইরে ড্রয়িং ও ডাইনিং কক্ষের প্রতিটি দরজায় লাগানো দামী কাঁচের পাতও উধাও। শশীলজের প্রতিটি জানালায় লাগানো রয়েছে নেট। যেন মশা-মাছিও ঢুকতে না পারে। এসবও নষ্ট হওয়ার পথে। রাজবাড়ির জানালা, দরজা ও করিডোরের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বসানো লোহার গ্রিলও লোপাট হয়ে গেছে। শশীলজের দুই পাশে রাজা ও রানির শোবার ঘরেও লাগানো ছিল দামী পাথর।

Mymensing Lead 1

শশীলজের পেছনে রয়েছে শানবাঁধানো ঘাটের বিশাল পুকুর। ঘাটের ওপর দ্বিতল স্নানাগারটি এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্নানাগারের ওপরে ও নিচের দুই পাশে আলাদা কক্ষে কাপড় পরিবর্তন করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগার থেকে শ্বেতপাথর বিছানো সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরের ঘাট হয়ে নিচ পর্যন্ত। দৃষ্টিনন্দন এই স্নানাগারের এক পাশে ছিল মিনি মিউজিয়াম। শশীলজ থেকে সখি বেষ্টিত রাণী চলে যেতেন পুকুর ঘাটের ওই স্নানাগারে। বিনোদন আর জলকেলির পর শ্বেতশুভ্র হয়ে ফিরতেন রাজপ্রাসাদের অন্তপুরে।

রাজবাড়ির বিশাল ক্যাম্পাসে নাগলিঙ্গম ও লক্ষ্মীবিলাশসহ অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়েছে। পরিচর্যার অভাবে এসব বৃক্ষও এখন বিলিনের পথে। প্রচার রয়েছে, জমিদাররা হাতি পালতেন। হাতির পছন্দের খাবার ছিল এই নাগ লিঙ্গমের ফল।

আহমদ তৌফিক চৌধুরীর ‘শহর ময়মনসিংহের ইতিকথা’ থেকে জানা যায়, মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ শহর নিয়ন্ত্রণ করতেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। পরবর্তীতে সুষ্ঠুভাবে শাসনকাজ পরিচালনার জন্য পালিত ছেলে শশীকান্ত আচার্যের নামে ময়মনসিংহ শহরে নির্মাণ করলেন দ্বিতল পাকা বসতবাড়ি শশীলজ। এতে ওপরে ওঠার জন্য একটি মিউজিক্যাল স্টেয়ার (সিঁড়ি) লাগানো ছিল। ফ্রান্স থেকে আমদানি করা এই স্টেয়ার কেস বেয়ে ওপরে ওঠার সময় একধরনের মিউজিক বেজে উঠতো।

১৮৫৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মহারাজের এই দ্বিতল বসতবাড়ি ধসে পড়ে। দূর্গাপুরের জমিদার রাজা জগৎ কিশোরের ১২ বছরের কিশোর ছেলে তখন দেয়ালচাপায় মারা যান। মহারাজ শশীকান্ত তখন কলকাতায় ছিলেন। টেলিগ্রামে ভূমিকম্পের খবর পাঠানো হলে শশীকান্ত অপর প্রান্ত থেকে জানতে চেয়েছিলেন তার স্টেয়ার কেসের কথা। এরপর থেকে ময়মনসিংহ শহরে দীর্ঘদিন পাকা দ্বিতল বাড়ি নির্মাণে মহারাজের বারণ ছিল। পরে সেখানে নির্মাণ করা হয় আজকের এই একতলার সুরম্য দালানবাড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে, শশীলজ থেকে সুরঙ্গপথে মুক্তাগাছা রাজবাড়ির যোগাযোগ ছিল।

Mymensing Lead 1

শশীলজটি ১৯৫২ সাল থেকে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাতবদলের পর এখন শশীলজের বসতভিটার দায়িত্ব পেয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। তারা বাড়ির প্রথম দিকের তিনটি কক্ষ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। এর পাশে এখনো চলছে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (মহিলা) কার্যক্রম। ৯ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে বহুতল ভবনের স্থাপনায় অ্যাকাডেমিক, ট্রেনিং, ডেমনেস্ট্রেশন স্কুল ও বিএড শিক্ষার্থীদের আবাসিক হোস্টেলের কার্যক্রম চলছে। এর সঙ্গে রয়েছে অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক কোয়ার্টার।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, শশীলজের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বছরজুড়ে অসংখ্য পর্যটক ও দর্শনার্থী টানা সক্ষম। আর এ থেকে আসা খরচে মেটানো যেতো অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর রক্ষণাবেক্ষণ, সরকারেরও আয় বাড়তো।

ময়মনসিংহের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ফরিদ আহমেদ দুলাল বলেন, শশীলজ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগের ধারায় এটির সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে আসবেন। এর রক্ষণাবেক্ষণের যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের উচিত হবে শশীলজকে ধ্বংসের হাত থেকে ফিরিয়ে আনা। নতুন প্রজন্মকে জমিদারদের শাসন আমলের কাহিনি জানাতে হলে শশীলজকে টিকিয়ে রাখতেই হবে।

Mymensing Lead 4

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমরা ২০১৫ সালে শশীলজের ৯ একর জমির মধ্যে মূল বাড়িসহ প্রায় সাত একর জমি বুঝে পেয়েছি। বাকি দুই একর জমিতে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ কার্যক্রম চালাচ্ছে। মূল বাড়িতে ২৩টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে সেন্ট্রাল তিনটি কক্ষ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি ২০টি কক্ষ একেবারেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। শশীলজের রক্ষণাবেক্ষণে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা রয়েছে। ভেতরের যে অবস্থায় ছিল তার একই রকম আছে জানান তিনি।

এদিকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শশীলজকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানান তিনি।