উচ্ছেদ আতঙ্কে বাঁধে আশ্রিত শত শত পরিবার

‘যেদিন থাকি মাইকিং শুনছি সেদিন থাকি আমি দুনিয়াত নাই। আমাদের তো যাওয়ার জায়গা নাই। চারটা বাচ্চাক নিয়া কোথায় যাবো? আমাদেক একটা থাকার জায়গা করি দেন। নাইলে আমাদেক তুলি দেন না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ভূমিহীন নারী মোসলেমা (৩৫)।

মোসলেমা তার চার সন্তানসহ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের শান্তিপুর ওয়াপদা বাঁধে বসবাস করেন। তার স্বামী নুর জামাল জেলার বাইরে খামারশ্রমিকের কাজ করেন। উচ্ছেদ আতঙ্কে দিশেহারা এই নারী সন্তানদের নিয়ে কোথায় উঠবেন তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। 

উপজেলার ভিতরবন্দ ও নুনখাওয়া ইউনিয়ন জুড়ে বিস্তৃত এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে। তাদের বেশির ভাগই বানভাসী ও ভূমিহীন। কিছু পরিবারের জমিজমা থাকলেও বন্যায় প্লাবিত হয় বলে সেগুলোতে কেউ বসবাস করেন না। এসব পরিবার বন্যার সময় বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিল। পাউবোর মাইকিংয়ের পর মোসলেমার মতো বাঁধে আশ্রয় নেওয়া শত শত পরিবারে এখন উচ্ছেদ আতঙ্ক চলছে।

উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকা মোসলেমাবাঁধের পাড়ে আশ্রয় নিয়ে বসবাসকারী মৎস্যজীবী আনিসুর (৫০) বলেন, ‘এলাকার অভাবী আর ভূমিহীনরা বাঁধের পাড়ে ঘরবাড়ি করে বসবাস করতেছি। বানের হাত থাকি বাঁচার জন্যে বাঁধের পাড়ে থাকি। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে মাইকিং করি বাড়িঘর সরাইতে বলছে। এই মানুষগুলাক বাড়ি করি থাকার জায়গা দেউক। না হইলে এই অভাবী মানুষগুলা যাবে কোথায়!’

আনিসুর জানান, বন্যা আর ভাঙনে সর্বহারা পরিবারগুলো বাঁধের পাড়ে বসবাস করে। পরিবারগুলোর বেশির ভাগই ভূমিহীন, দিনমজুর। অনেক বিধবা নারীও সন্তানদের নিয়ে বাস করেন। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের উচ্ছেদ করলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে।

ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য সাইফুর রহমান বলেন, ‘বাঁধে আশ্রিত বেশির ভাগ পরিবার ভূমিহীন। অনেকের জমি থাকলেও বন্যার পানি ওঠে বলে সেখানে বাস করতে চান না। উচ্ছেদ করলে অনেক পরিবার বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।’

এই ইউপি সদস্য জানান, পাউবোর বাঁধ ৮০ ফুট প্রশস্ত হবে। এর বাইরে উভয় দিকে প্রায় ১০০ ফুট জায়গা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো দখল করে অনেকে মাছ চাষ করছে। ওই স্থানগুলো ভরাট করে সেখানে বাস করার সুযোগ দিলেও অনেকে ঘরবাড়ি করে থাকতে পারবে।

নুনখাওয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বাঁধে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। বাঁধের পাশে অনেক সরকারি জায়গা আছে। সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিলে এই পরিবারগুলো রক্ষা পেতো।’

বাঁধ থেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে মাইকিং করার কথা স্বীকার করে পাউবো, কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নদীশাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট থেকে নাগেশ্বরী হয়ে সদরের যাত্রাপুর ও পাঁচগাছী ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ থেকে ৩৬ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করা হচ্ছে। এজন্য ওই বাঁধে যারা আশ্রয় নিয়ে আছেন তাদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। আগামী এক দেড় মাসের মধ্যে এই কাজ শুরু হবে।’

ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করার প্রশ্নে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘আমাদের এই প্রকল্পে পুনর্বাসন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত নেই। পুনর্বাসন স্থানীয় প্রশাসন করবে। এজন্য আমরা আগে থেকে মাইকিং করছি। তা ছাড়া আমাদের কাজের সীমার বাইরে যেসব বাড়িঘর আছে সেগুলো না সরালেও চলবে। তবে বাঁধ ঘেঁষে যাদের বাড়িঘর রয়েছে তাদের সরে যেতে হবে।’

নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা জাহান বলেন, ‘বাঁধে আশ্রিতদের উচ্ছেদের বিষয়ে এখনও আমাকে কিছু বলা হয়নি। তাদের (পাউবোর) প্রকল্পে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখবো। আশ্রিতদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’