ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে তাকে কক্ষ থেকে ডেকে নেন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ির করিডোর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন।
সোমবার (৭ অক্টোবর) কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরারের বাড়িতে তার মা রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। শুনশান বাড়িতে তিনি একাই ছিলেন। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুয়েটে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তার বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকায় গেছেন।
অশ্রুসিক্ত চোখে আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ৬ অক্টোবর ছেলেকে সকালে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। বিকালে বুয়েটে পৌঁছায়। এরপর তাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ডেকে রাতভোর নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। তারা ছাত্রলীগ করলেও তাদের কয়েকজন আবরারের বন্ধু ছিল। তারাও একটি বারের জন্যও ফোনে জানায়নি ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে।’
শোকাতুর রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলের আম্মু আম্মু ডাক এখনও কানে বাজে। ভুলতে পারি না। কীভাবে ভুলবো? তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা মনে হলেই শিউরে উঠি।’
তিনতলা বাড়িটির নিচতলাতে থাকে আবরারের পরিবার। একটি কক্ষ বেশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের একপাশে বড় একটি শোকেস। সেটির পাশে দাঁড়িয়ে আবরারের মা বলেন, ‘ছেলে বুয়েটে যে বিছানায় থাকতো। সেখান থেকে সবকিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নেওয়া হয়েছে। তার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি।’
শোকেসের ভেতর হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ব্যাগ, বইপত্র, প্রসাধনী, আইডিকার্ডসহ আরও অনেক কিছুই যত্নে রেখেছেন। জুতা, একটি গ্লোব, পোশাক, জায়নামাজ ও তসবিহ রয়েছে।
কিছু চকলেট দেখিয়ে আবরারের মা বলেন, ‘আবরার ঘুমানোর সময় চকলেট মুখে দিয়ে ঘুমাতো। এগুলো পাঁচ বছর ধরে আগলে রেখেছি। হাতঘড়ির কাটা বন্ধ হয়ে গেছে।’ ঘড়িটি দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আর কতদিন চলবে?’
তিনি বলেন, ‘আবরার সব সময় দেশের ভালোর জন্য লিখতো। দেশ নিয়ে ভাবতো। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু লিখেই সে একটি দলের কাছে শত্রু হয়ে গিয়েছিল। আবরার কোনও রাজনীতি করতো না। তাহলে কেন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে? আর যারা হত্যা করলো তারা তো তারই বন্ধু ছিল। তারা কি দেশের ভালো চাইতো না?
‘হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায়ে আসামিদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। সব আসামির দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের জোর দাবি জানাই।’
এর আগে রবিবার (৬ অক্টোবর) রাতে আবরারের ছোট ভাই বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আবেগঘন দুটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফেসবুকে ফোনকল রেকর্ডসহ একটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন:
‘৫ বছর আগের এই রাতে ভাইয়ার শেষ ফোন কল ছিল এটি, ভাইয়ার এক স্টুডেন্টের মায়ের সঙ্গে। এর পরেই ভাইয়াকে মারতে শুরু করে। এই রেকর্ড থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ওই সময়ে কী পরিমাণ ভয় ভাইয়া পেয়েছিল। কিন্তু খুনিগুলো তাও কোনও দয়া দেখায়নি। অথচ যারা এই খুনিদের তৈরি করেছিল, তাদেরই ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এখন!
‘৬ অক্টোবর ২০১৯-এর রাত ৯টা ৪০-এর কথোপকথন। আম্মু ১১টা ১৬তে দুইবার ফোন দিলেও আর ধরতে দেয়নি।’
আবরার ফাইয়াজ রবিবার রাত ১০টার দিকে তার ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাসে লেখেন:
‘২০১৯ সালের আজ অর্থাৎ ৬ অক্টোবর ভাইয়া ঢাকাতে যায়। ২৬ সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়াতে আসার পরেই ইলিশ আর ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে দুটি পোস্ট দিয়েছিল। সেদিন আম্মু নিজে ভাইয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। এরপর মাত্র ১৩-১৪ ঘণ্টার মধ্যে ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। আর ২০ ঘণ্টা পরই বাসায় আসে মৃত্যুর সংবাদ।
‘সেদিন সকালে যাওয়ার আগে ৯টার দিকে আম্মু আমাকে ডেকেছিল, “ভাইয়া চলে যাচ্ছে, ওঠ।” কিন্তু ভাইয়া বলে, “না থাক, অনেক রাতে ঘুমাইছে ঘুমাতে দাও।” আমি চলে গেলাম। তুই (ফাইয়াজকে উদ্দেশ করে) বেশিদিন থাকিস না, তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে আসিস।
‘যাওয়ার আগের রাতে আম্মুকে ভাইয়া বলেছিল, “আম্মু অনেক ছারপোকা কামড়ায়। পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দাও তো। কোনও দাগ হয়ে গেছে নাকি? আচ্ছা তোমার কাছে কি এমন কোনও ওষুধ আছে যা লাগালে আর কামড়াবে না আমাকে?”
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নেন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ির করিডোর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। আবরার ফাহাদের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডে।
এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তা আমলে নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৫ জনকে।