মূলত এটি ‘পৌষ মেলা’। কেউ বলে ‘জামাই মেলা’, আবার কেউ বলে ‘মাছের মেলা’। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বিনিরাইল (কাপাইস) গ্রামের এই মেলাকে ঘিরেই সেখানে দিনব্যাপী চলে আনন্দ-উৎসব। দিনটির জন্য সারাটি বছর অপেক্ষায় থাকেন উপজেলাবাসী। আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে কালীগঞ্জের বিনিরাইল (কাপাইস) গ্রামে পৌষ মাসের শেষ দিনে বসে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা।
মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বিনিরাইল (কাপাইস) গ্রামে ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় বিপুল মানুষের সমাগম। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে অনেক মানুষ এই মেলায় এসেছেন। প্রতি বছর পৌষ-সংক্রান্তিতে একদিনের জন্য এ মেলা জমে ওঠে।
স্থানীয়রা জানান, পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে মেলাটির প্রচলন হয়। মূলত ‘পৌষ মেলা’ হিসেবে শুরু হলেও পরে এটি ‘জামাই এবং মাছ মেলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। মেলাকে কেন্দ্র করে জামালপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের শ্বশুররা তাদের জামাইকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানান। এ মাছের মেলাকে ঘিরে আশেপাশের কয়েক জেলার মানুষের সমাগমে এখানে দিনভর চলে আনন্দ-উৎসব। মাছের মেলা হলেও চলে এলাকার জামাইদের বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা। জামালপুর ইউনিয়নের বিনিরাইল, বক্তারপুর ও জাঙ্গালীয়াসহ আশপাশের গ্রামে যারা বিয়ে করেছেন, সেই জামাইরা হচ্ছেন মেলার মূল ক্রেতা ও দর্শনার্থী। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তাই এ মেলা জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়।
গাজীপুর চৌরাস্তার মা মৎস্য আড়তের মালিক শেখ সোহাগ ইসলামের মাছের স্টলে দেখা যায়, ক্রেতাদের জটলা লেগে আছে। ৯ ফুট লম্বা ৯২ কেজি ওজনের পাখি মাছ দেখতে জামাই, উৎসুক দর্শনার্থী এবং ক্রেতাদের ভিড়। বিক্রেতা প্রতি কেজি ৮০০ টাকা মূল্যে পাখি মাছের দাম হেঁকেছেন ৭৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় রামচন্দ্রপুর এলাকার জামাই খায়রুল বাশার হিরণ মাছটির দাম ৪০ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা বেশি দাম পাওয়ার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দর কষাকষি। ক্রেতার চেয়ে উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য।
রাজধানীর উত্তরখান থেকে এসেছেন সুব্রত কুমার। তিনি বলেন, ‘পৌষ মাসের শেষ দিনে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বিনিরাইলের মাছের মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ। কর্মব্যস্ততার কারণে খুব একটা সময় পাই না। আমি তিন বছর ধরে এ মেলায় হৃদয়ের টানেই ছুটে আসি।’
কালিয়াকৈরের সূত্রাপর থেকে শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন জামাই সোয়ায়েব হোসেন। তিনি বলেন, ‘অনেক বছরের পুরনো এ মেলাটি আমার দেখার খুব শখ ছিল। তাই শ্বশুরবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে আমি মেলায় এসেছি। মেলা থেকে কিছু মাছ শ্বশুরবাড়ির জন্য কিনে নিয়ে যাবো।’
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি মাওলানা আলী হোসেন বলেন, ‘পৌষ মেলাটি এখন “জামাই এবং মাছের মেলা”য় পরিচিতি পেয়েছে। এ মেলা এখন আমাদের ঐতিহ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সার্বজনীন উৎসবে রূপ নেওয়া মেলাটি এখন এই এলাকার মানুষের হৃদয়ের খোরাক। তবে একদিনের জন্য মেলা চললেও স্থানীয় জমির মালিকরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। মেলা কৃষিজমিতে বসার কারণে লোকজনের চলাচলে তাদের জমি ও ফসলের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।’
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, ‘পুরনো এই মেলাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে রয়েছে নানা ধরনের কথা। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জে এ ধরনের আয়োজনে আমাদের চিরায়ত বাংলার রূপই ফুটে ওঠে। বিনিরাইলের মাছের মেলাটি স্থানীয় একটি ঐতিহ্য।’