সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম অবশেষে শুরু হয়েছে সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। উচ্চ আদালতের আদেশের পর মামলার নথিপত্র দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসার পর মঙ্গলবার (৬ মে) আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে আগামী ১৩ মে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন বিচারক।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেন সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবুল হোসেন। তিনি জানান, বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলার সাক্ষ্য নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য আগামী ১৩ মে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
তবে বাদীপক্ষের প্যানেল আইনজীবীর প্রধান শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘মামলার বিষয়ে বাদী দীর্ঘদিন থেকে উদাসীন। উচ্চ আদালতের আদেশের পরই বাদী কোনও যোগাযোগ করেননি। যতটুকু শুনেছি, বাদী মঙ্গলবার (৬ মে) ট্রাইব্যুনালে অন্য দুজন আইনজীবীকে দিয়ে দরখাস্ত দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পদে পদে ছিল নানান প্রতিবন্ধকতা। এমনকি উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে আপিল দায়ের ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা কালে মামলার বাদী নেতাদের কথায় চলাফেরা করতেন। সেই সঙ্গে তাদের হুকুমও তিনি মেনে চলতেন। তিনি মামলাটি আপস করার জন্য মোটা অংকের টাকাও নিয়েছিলেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
জানা গেছে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মামলার নথিপত্র রবিবার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা গ্রহণ করেন। এর আগে গত ১৭ মার্চ সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা বদলি করতে হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ২০২০ সালে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় দুই অভিযোগের বিচার চলবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।
হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় গত ১৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ খারিজ করে এ আদেশ দেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জুন মাসে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে দুই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বদলি করতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়। ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে আসামিদের রক্ষায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণের অভিযোগ উঠলে সরকারের আইন মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ না করে আসামিদের রক্ষায় বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও কার্যত বিচারের কোনও অগ্রগতি হয়নি। তবে ২০২৩ সালের ২৬ জুন আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হরিপদ পাল স্বাক্ষরিত পত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরীকে লিভ টু আপিল দায়েরের বিষয়টি নোটিশ দিয়ে জানানো হয়। এরপর থেকে আসামিদের সিলেটের আদালতে তেমন একটা হাজিরও করা যায়নি।
আদালত সূত্র আরও জানায়, ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ সংঘবদ্ধধর্ষণ ও চাঁদাবাজির দুটি মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর চূড়ান্ত আদেশ দেন। এই আদেশে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট জারি করতে বলা হলেও শুধু তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের কারণে হাইকোর্টের ওই আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে ২০২২ সালের ১ আগস্ট বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বাদীপক্ষ একটি রিট দায়ের করলে ১৬ আগস্ট দুটি মামলার বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বদলির জন্য প্রক্রিয়া কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না বলে রুল জারি করেন আদালত। ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় আলোচিত ধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও এরপর আর কোনও অগ্রগতি হয়নি। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক ৮ আসামির উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ১১ মে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা চাঁদাবাজি ও ছিনতাই মামলার অভিযোগ গঠন করেন। এর আগে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি একই ট্রাইব্যুনালে সব আসামির উপস্থিতিতে অপহরণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সহায়তার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে দক্ষিণ সুরমার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন তারা। এ সময় কয়েকজন যুবক তাদের ঘিরে ধরে। একপর্যায়ে তাদের জিম্মি করে গাড়িতে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। পরে জানা যায়, ধর্ষণকারী ওই যুবকরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ওই ঘটনায় গত বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণ মামলার ও চলতি বছরের মে মাসে চাঁদাবাজির মামলার অভিযোগ গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুই হয়নি।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুমকে (২৫) অভিযুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে পুলিশ। এতে ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার মাত্র ২ মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেওয়া হয়। আসামি রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুমকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ঘটনার পরে গ্রেফতার আট জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিক্যালের ওসিসির মাধ্যমে আসামিদের ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। নমুনা সংগ্রহের প্রায় ২ মাস পর ডিএনএ রিপোর্ট এসে পৌঁছে। ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ‘ম্যাচিং’ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামি করে অস্ত্র আইনে আরেকটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ঘটনার এক মাস ২৭ দিন পর অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এদিকে, গ্রেফতারের পর আট আসামির সবাই অকপটে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নববধূকে সরাসরি ধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে। আট আসামির সবাই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপে সক্রিয় ছিল।