হালিমা খাতুন। বর্তমানে থাকেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার হাড়িভাঙ্গা এলাকায় মেয়ে জামাই আব্দুল হাকিমের বাড়িতে। সেখানেই কথা হয় এই প্রতিনিধির সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
‘আমরা থাকতাম নওগাঁর আদমদীঘি উপজেলার ধামকুড়ি এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে আমার ছেলে ও স্বামী। এ কথা রাজাকারদের মাধ্যমে পাক্স্তিানি সেনাদের কানে গেলে ওরা আমদের বাড়ি আক্রমণ করে। এরপর আমার চোখের সামনেই স্বামী, দুই ছেলে, ভাসুর ও দেবরসহ এলাকার কয়েকজন বাঙালিকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। বাড়ির পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় হত্যার পর লাশ গুম করে রাখে (জায়গাটি এখন গণকবর)। এমন পরিস্থিতিতে চার মেয়েকে নিয়ে কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। এর সুযোগ নেয় লম্পট এক পাকিস্তানি সেনা সদস্য...।’
আঁচলে চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বৃদ্ধা হালিমা খাতুন। এরপর বলেন, ‘ একে তো স্বামী-সন্তান হারিয়েছি, তার ওপরে সম্ভ্রম হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়ি। এক সময় স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলি। এ অবস্থায় ‘দুলদুল’ নামে এক আত্মীয় ও এক মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতায় চার মেয়েকে নিয়ে পাবনায় বড় বোন আমেনার বাড়িতে পালিয়ে যাই ।’
হালিমা বলেন,‘পাবনা মানসিক হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি ফিরে পাই। পরে চার মেয়েসহ তাকে দিনাজপুরের বিরামপুরে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন বড় বোন।’
পরিবার সদস্যরা জানান, যুদ্ধ শেষ হলে তৎকালীন সরকার ১৯৭২ সালের ২৯ জুন হালিমা খাতুনকে ঠাকুরগাঁও টিবি ক্লিনিকে ‘লেডি হোম ভিজিটর’ পদে চাকরি দেন। যার স্মারক নম্বর ডিডিএইচআর/ই-২৪/৭২/২৪৫৭/১(৫)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বামী এ কে এম নুরুল ইসলামসহ দুই সন্তানকে পাক সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করায় এবং হালিমা খাতুনের সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়ায় তৎকালীন সরকার (১৯৭২ সালের ২৯ জুন) তাকে ‘লেডি হোম ভিজিটর’ পদে চাকরির ব্যবস্থা করেন। ওই নিয়োগপত্রে স্পষ্টভাবে এসব তথ্যের উল্লেখ থাকলেও স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ পরিবারের তালিকায় স্বামী কিংবা সন্তানদের নাম ওঠেনি। এমন কী তার নামও বীরাঙ্গনার তালিকায় নেই! তবে ঢাকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তরের স্মৃতিফলকে বড় ছেলে শহীদ এ কে এম আমিনুল ইসলামের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে।
হালিমা তার নিয়োগপত্র দেখিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের দেওয়া লেডি হোম ভিজিটর পদের চাকরিটা আমাকে দেন এই ত্যাগ স্বীকারের কারণেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার তেমন কিছুই চাওয়ার নেই। শুধু স্বামী ও সন্তানদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতিটুকুই চাই। রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত হয়ে উঠবে আগামীর প্রজন্ম।’
হালিমা খাতুনের মেয়ের স্বামী আব্দুল হাকিম বলেন, ঠাকুরগাঁও টিবি ক্লিনিক থেকে ১৯৯২ সালের ৫ জুন অবসর গ্রহণ করেন। পরে স্বামীর ভিটে নওগাঁর আদমদীঘির ধামকুড়িতে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে তিনি সবসময় কান্নাকাটি করতেন। পরে আমার স্ত্রী সাইদা শাশুড়িকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের তালিকায় নাম না ওঠা প্রসঙ্গে আব্দুল হাকিম বলেন, ভেবেছিলাম যেহেতু সরকারিভাবেই শাশুড়ির চাকরি হয়েছিল। একইভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ পরিবারের তালিকায় শ্বশুর ও শ্যালকদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় এবার গেজেট অন্তর্ভুক্তির জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করা হয়েছে।’
/বিটি/টিএন/