রিফাতের খুনিদের রায় কার্যকরের দাবি মা-বাবার

‘আর কয়দিন বাঁচমু কইতে পারি না। তয় পোলাডার (রিফাতের) খুনিগো বিচার দেইখা মরতে চাই। রিফাত ছাড়া ঘরডা খাঁ খাঁ করে। মোর কোল যারা খালি করছে, আল্লাহ হেগো বিচার দেহায়া তুমি মোরে এই পৃথিবী থেকে নিও।’ বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপচারিতায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বরগুনায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার রিফাত শরীফের মা ডেইজি আক্তার।

রিফাত শরীফ হত্যার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ (২৬ জুন)। এ নিয়ে কথা হয় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘বরগুনার আদালতে আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে যে রায় দিয়েছে, তাতে আমি ও আমার পরিবার সন্তুষ্ট। এখন শুধু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত হলেই আমার ছেলের হত্যাকারীদের সাজা হবে। আমার ছেলে হত্যায় যাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আমি সেই রায় কার্যকর দেখে মরতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্থবির হয়ে পড়েছে নিয়মিত সব কার্যক্রম। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলছে আদালতের জরুরি বিচারকার্য। করোনার এই ভয়াবহ অবস্থা না হলে হয়তো এতদিনে উচ্চ আদালতের শুনানির কার্য সম্পন্ন হতো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আশা করি, খুব দ্রুত হত্যাকারীদের রায় কার্যকর দেখতে পাবো।’

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের দুই বছর হলেও এখনও রিফাতের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে পরিবার। প্রতিদিন ছেলের কবরের পাশে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন তার মা-বাবা ও একমাত্র বোন। স্বজনদের দাবি, আদালত খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন এ মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।

২০১৯ সালের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন বিকালে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।

ঘটনার পরদিন ২৭ জুন রিফাতের বাবা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর পুলিশ একে একে গ্রেফতার করেন এজাহারভুক্ত আসামিদের। রিফাতের ওপর হামলার ছয়দিন পর ২ জুলাই ভোর রাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড।

রিফাত হত্যাকাণ্ডের দুই মাস ছয় দিন পর ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকালে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এদের মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।

প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত চার্জ গঠন করেন। ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মোট ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেন আদালত। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করেন ৩০ সেপ্টেম্বর।

রায়ে মামলার সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনকে ফাঁসি এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া চারজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। বরগুনা জেলা দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় দেন।

মৃত্যু ও অর্থদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি (২৩), আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) এবং আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)।

ছেলের করবের পাশে অশ্রুশিক্ত নয়নে নির্বাক দাঁড়িয়ে বাবা

এরই মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ২৯ অক্টোবর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মিন্নিকে বরগুনা জেলা কারাগার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে নেওয়া হয়। একই সময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন পুরুষ আসামিকে বরগুনা জেলা কারাগার থেকে বরিশাল বিভাগীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি দুইজন বরগুনা কারাগারে রয়েছেন।

এদিকে, ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত। ৭৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ২৭ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে ছয়জনকে ১০ বছর, চারজনের পাঁচ বছর, একজনের তিন বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন শিশু আদালতের বিচারক হাফিজুর রহমান। এছাড়া তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

১০ বছর সাজাপ্রাপ্তরা হলো- মো. রাশিদুল হাসান রিশান ওরফে রিশান ফরাজী (১৭), মো. রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার (১৫), মো. আবু আবদুল্লাহ ওরফে রায়হান (১৬), মো. ওলিউল্লাহ অলি (১৬), মো. নাইম (১৭) এবং মো. তানভীর হোসেন (১৭)। পাঁচ বছর সাজা হয়েছে- জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন (১৭), নাজমুল হাসান (১৪), রাকিবুল হাসান নিয়ামত (১৫), মো. সাইয়েদ মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লা (১৭)। তিন বছর কারাদণ্ড পেয়েছে- প্রিন্স মোল্লা (১৫)।

জানতে চাইলে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, দেশবাসী দেখেছে রিফাতকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেছিল। নিজের স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে না মিন্নি। তবু আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। উচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় আছি।