মেম্বারের ‌‌ইয়াবা হাট, দিনে বিক্রি ২ লাখ

বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের গাজীর খেয়াঘাট গুচ্ছগ্রাম এলাকাকে ‘ইয়াবার হাট’ বানিয়েছেন রাসেল হাওলাদার নামে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি। তিনি ৩ নম্বর চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার)। বর্তমানে ২৩টি মামলার আসামি। তবু রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার নেতৃত্বে গুচ্ছ গ্রাম এলাকায় দিনে দুই লাখ টাকার ইয়াবা বেচাকেনা হয়। ইতিমধ্যে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে অনেক তরুণ-তরুণী বিপথে গেছেন। অনেকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের প্রতিবাদের মধ্যেও কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবা বেচাকেনা।

নগরীর কাউনিয়া থানা পুলিশ বলছে, বিভিন্ন সময়ে গুচ্ছগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাসেল হাওলাদারের সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়। তারা আবার জামিনে বেরিয়ে মাদক বিক্রি শুরু করেন। সর্বশেষ গত ১ জুন তালতলী ব্রিজ এলাকা থেকে রাসেল হাওলাদারের সহযোগী মো. শাওনকে ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর রাসেল মেম্বারের হয়ে ইয়াবা বিক্রির কথা জানান শাওন। পরে রাসেল মেম্বার, শাওন ও তাদের আরেক সহযোগীকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার পর থেকে রাসেল মেম্বার পলাতক। এখন তার সহযোগীরা গোপনে ইয়াবা বিক্রি করেন, খবর পেলেই অভিযান চালায় পুলিশ।

কাউনিয়া থানা পুলিশের তথ্যমতে, রাসেল মেম্বারের বিরুদ্ধে কাউনিয়া থানায় ২৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ মাদক মামলা। বাকি পাঁচটি মামলা হয়েছে মারামারি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুচ্ছগ্রাম এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সবাইকে ম্যানেজ করে সহযোগীদের দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন রাসেল মেম্বার। তার সহযোগী হয়ে কাজ করছেন চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাওন ব্যাপারী, আলামিন মোল্লা, বাবু ওরফে ল্যাপটপ বাবু, রুবেল সরদার এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সালাম চৌকিদার, মামুন ফকির, সাইমুদ্দিন, হারেজ গাজী, আইয়ুব আলী ও সাইফুল সরদারসহ অর্ধশতাধিক যুবক। এ ছাড়া ব্যবসা পরিচালনার জন্য মেম্বারের রয়েছে দুটি ট্রলার ও একটি পিকআপ। সহযোগীদের কেউ গ্রেফতার হলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান রাসেল মেম্বার, পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে গোপনে এলাকায় ফেরেন। তার অনুপস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা করেন স্ত্রী শিরিন বেগম। তাদের কাছে কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান আসে।

গুচ্ছগ্রাম এলাকার দুই জন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানিয়েছেন, সহযোগী শাওন গ্রেফতার হওয়ার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান রাসেল হাওলাদার। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে বাড়িতে পায়নি। গত কয়েকদিন ধরে শায়েস্তাবাদের হবিনগরের চরে ইউসুফ মোল্লার বাড়িতে অবস্থান করছেন রাসেল। প্রতি রাতে এলাকায় ফিরে ইয়াবা বিক্রির হিসাব নেন। আবার সকালে এলাকা ছেড়ে চলে যান। তবে ব্যবসা চালাচ্ছেন সহযোগীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাসেল মেম্বারের দুই সহযোগী জানিয়েছেন, গাজীর খেয়াঘাট গুচ্ছগ্রাম এলাকা ইয়াবা বিক্রির প্রধান হাট। মেম্বারের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন অন্তত অর্ধশতাধিক যুবক। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ইয়াবা কিনতে আসেন। পাইকারিতে প্রতি পিস ৭০-৮০ টাকায় কেনে খুচরায় ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। দিনে অন্তত দুই লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। কখনও কোনও সহযোগী গ্রেফতার হলে মেম্বার তার লোক দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন। 

তারা আরও জানান, যারা নিয়মিত ক্রেতা, তাদের কাছ থেকে দাম কিছুটা কম রাখা হয়। তবে তা নির্ভর করে রাসেল মেম্বারের নির্দেশের ওপর। এভাবে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। দিনে সর্বোচ্চ দুই লাখ এবং সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকার ইয়াবা বিক্রি হয়। হিসাবে মাসে অর্ধকোটি টাকার বিক্রি হয়। প্রতিদিন সাত থেকে আটশ’ ইয়াবা বিক্রি হয়। তবে বিভিন্ন দিবসে বিক্রি বেশি হয়। 

গুচ্ছগ্রাম এলাকায় ইয়াবা কিনতে আসা চার যুবক জানিয়েছেন, মোবাইলে যোগাযোগ করে সেখানে আসার পর টাকা দিলে ইয়াবা দেওয়া হয়। খুচরায় ২৫০ টাকায় পিস বিক্রি হয়। একজন ক্রেতা সর্বনিম্ন দুটি এবং সর্বোচ্চ ১০টি কিনতে পারেন। তবে বেশি কিনলে টাকার পরিমাণ কম রাখা হয়।

চরবাড়িয়া ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, রাসেল মেম্বারের মদতদাতা চরবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাতাব উদ্দিন সুরুজ। তার নির্বাচনে এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অর্থের জোগান দিয়ে আসছেন রাসেল। এ ছাড়া পুলিশের কিছু সদস্য, স্থানীয় কয়েকজন নেতাকে মাসোয়ারা দিয়ে আসছেন। 

তবে রাসেল মেম্বারকে মদত দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ৩ নম্বর চরবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহাতাব উদ্দিন সুরুজ। তিনি বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী রাসেল মেম্বারের সঙ্গে আমার কোনও সম্পৃক্ততা নেই। প্রতিপক্ষের লোকজন এসব ছড়াচ্ছেন। রাসেল মেম্বার ইয়াবা ব্যবসা করেন, এটি পুলিশও জানে।’

নগরীর নিউ লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা ছয় যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা চরবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা। রাসেল মেম্বারের সহযোগীদের কাছ থেকে ইয়াবা কেনে সেবন করতেন। বন্ধুদের মাধ্যমে নেশায় আসক্ত হন। একপর্যায়ে গুরুতর অবস্থায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন।

তারা বলছেন, ইয়াবা সহজলভ্য হওয়ায় এই নেশায় আসক্ত হচ্ছেন তরুণরা। তরুণীরাও আসক্ত হচ্ছেন। তবে তরুণীরা নিজেরা না কেনে বন্ধু ও সহযোগীদের দিয়ে কেনে সেবন করেন।

মাদকের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তপন কুমার সাহা বলেন, ‘ইয়াবা সেবনকারীরা চার মাসের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ধীরে ধীরে নিজেকে একা ভাবতে শুরু করেন। এসব কারণে পারিবারিক কলহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটান ইয়াবা সেবনকারীরা।’

নিউ লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোর্তুজা জুয়েল বলেন, ‘সহস্রাধিক মাদকাসক্ত রোগী নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ইয়াবায় আসক্ত। এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।’

২৩ মামলার আসামি হওয়ার পরও রাসেল মেম্বার কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে জানতে চাইলে কাউনিয়া থানার ওসি আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমি এই থানায় নতুন যোগ দিয়েছি। শুনেছি তার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। এরপরও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একই বিষয়ে জানতে চাইলে কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হরিদাস নাগ বলেন, ‌‘সর্বশেষ মামলায় ইয়াবা ব্যবসায়ী রাসেল মেম্বারের সহযোগী শাওন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে গডফাদার হিসেবে রাসেল মেম্বারের কথা জানান শাওন। এরপর বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিতভাবে জানানো হয়। সহযোগী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক। তাকে গ্রেফতারে পুলিশসহ বিভিন্ন টিম কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা যাবে।’