৩৭ বছর আগের সামান্য উদ্যোগ এখন ৮৫০ শয্যার হাসপাতাল!

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালকয়েকজন সমাজকর্মীর ‘সামান্য’ উদ্যোগ এমন মহীরূহ হয়ে দাঁড়াবে কেউ ভাবেননি হয়তো। হাতেগোনা ১৫/২০ জনের ছোট প্রচেষ্টা কয়েক দশকে হাজারো মানুষের জন্য যে সেবা পাওয়ার বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হবে তা অনেকের জন্যই কল্পনাতীত ছিল। কিন্তু সেটাই এখন বাস্তব। ১৯৭৯ সালে কয়েকজন ডাক্তার ও সমাজকর্মীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল’  এখন ৮৫০ শয্যার বিশাল এক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে।

নির্মাণাধীন নতুন ভবনের কাজ শেষ হলে বর্তমানে ৬৫০ শয্যার এই হাসপাতাল শিগগিরই ৮৫০ শয্যায় উন্নীত হবে। তখন অত্যাধুনিক সব সুযোগ সুবিধাসহ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন এই অঞ্চলের রোগীরা।

হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর মো. মোশারফ হোসাইন জানান, ৩৭ বছর আগে দুস্থ শিশুদের চিকিৎসা দিতে এ হাসপাতালের জন্ম। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে দুস্থ রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে এখানে। তিনি আরও জানান, এটি একটি চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠান। জনগনের অর্থে এটি পরিচালিত হয়।

তিনি জানান, আউট ডোর সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু। তবে পরে রোগী ভর্তি করাও শুরু হয়। এখন পুরোদমে একটি আন্ত বিভাগ চালু রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ৬৫০ শয্যায় এখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী সেবা নিচ্ছেন। শয্যা সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। নির্মানাধীন নতুন ভবনটির কাজ শেষ হলে এটি আগামী বছরই এটি ৮৫০ শয্যায় উন্নীত হবে।’

হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র নামে যে ইউনিট রয়েছে সেখানে চট্টগ্রাম বিভাগের দূরবর্তী জেলার মানুষজনও তাদের সন্তানদের চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন। সাত বছর বয়সী ছেলের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে আসেন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার আশরাফ আলী। আড়াই বছর বয়সী শিশু সন্তান নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন কক্সবাজারের আইনুন নাহার। তারা জানান, এখানে চিকিৎসার মান ঢাকার অনেক বড় হাসপাতালের চাইতেও ভালো মনে হচ্ছে তাদের কাছে। সেবার মান ও আন্তরিকতা সবই পাচ্ছেন এখানে।

শুরুর কথা

খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা. এ এফ এম ইউছুফ, ডা. অধ্যাপক ফজলুল করিম ডা. এম নুরুন্নবীসহ বিভিন্ন পেশার ২০ জন মিলে দুস্থ শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর (আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ) তারা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে পরিত্যাক্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ভবনে ছোট পরিসরে এ সেবা চালু করেন। ধাপে ধাপে সাতটি পর্যায়ে শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ জেনারেল হাসপাতালে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৮৫ সালে ১০ শয্যা নিয়ে ইনডোর বিভাগ শুরু হয়। ওই বছরই হাসপাতালটিকে ২০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে ৩০ শয্যা,  ১৯৯১ সালে ১০০ শয্যা, ১৯৯৫ সালে ২০০ শয্যা, ১৯৯৬ সালে ২৫০ শয্যা, ২০০৯ সালে ৫০০ শয্যা এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে এটিকে ৬৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়।

জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ১২০০ লোক কাজ করছেন। চিকিৎসক প্রায় সাড়ে তিনশ। রোগীদের অত্যাধুনিক চিকিৎসা দিতে গত বছর ১২৮ স্লাইড বিশিষ্ট নতুন সিটিস্ক্যান মেশিন, ভিডিও এন্ডোস্কপি ও কলপোস্কোপ মেশিন আনা হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে অনকোলজি বিভাগ চালু করা হয়েছে। শিগগিরই আলাদা ভবন নির্মাণ করে বিশ্বমানের ক্যান্সার নিরাময় কেন্দ্র খোলা হবে।চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল

এদিকে দীর্ঘ ৩৫ বছরের এ পরিক্রমায় শুধু শয্যা সংখ্যা বেড়েছে তা নয়, সেবার মানও বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে হাসপাতালটির বহির্বিভাগে শিশু স্বাস্থ্য, মেডিসিন, অবস অ্যান্ড গাইনি, জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, শিশু সার্জারি, নাক-কান-গলা, চোখ, দাঁত, চর্ম ও যৌন রোগ, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, মানসিক রোগ, এজমা ক্লিনিক, ল্যাকটেশন ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, ইপিআই প্রোগ্রাম,  ডক্টরর্স কর্নার, কনসালটেন্সি সার্ভিস, বিভিন্ন সাব-স্পেশালিটি ক্লিনিক, ব্লাড ব্যাংক ইত্যাদি সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

অন্যদিকে আন্তঃবিভাগে মেডিসিন, শিশু স্বাস্থ্য, নিওনেটলজি, শিশু নিউরোলজি, অবস অ্যান্ড গাইনি, জেনারেল সার্জারি, শিশু সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, নাক-কান-গলা ও চক্ষু বিভাগের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা হিসেবে চালু রয়েছে এডাল্ট আইসিইউ, সিসিইউ, এইচডিইউ, এনআইসিইউ, শিশু আইসিইউ, শিশু এইচডিইউ, শিশু সিসিইউ, থেলাসেমিয়া ইউনিট, কিডনি রোগীদের জন্য হেমোডায়ালাইসিস ইউনিট, ইউরোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, গ্যাস্ট্রোএন্টারলজি বিভাগ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য অত্যাধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা সহ বিশেষায়িত শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। পাশাপাশি ৮৫০ শয্যার আরও একটি নতুন ভবন তৈরি করা হচ্ছে।

হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, ‘কিছু মহৎ মানুষের অনুদানে এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হাসপাতালের যাবতীয় উন্নয়ন কাজ মানুষের অনুদানে হয়ে আসছে। তবে ইদানিং সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বরাদ্দ পাওয়া যায়, যা হাসপাতালের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খরচ করা হয়। অন্যদিকে হাসপাতালের নিজস্ব আয় দিয়ে এখানে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনভাতা দেওয়া হয়।’

তিনি আরও জানান, ‘নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ২০০৬ সালে হাসপাতালে মেডিক্যাল কলেজ (অ্যাকাডেমিক) কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে এই মেডিক্যাল কলেজ থেকে ৬টি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বের হয়ে গেছেন।’

মো. মোশারফ হোসাইন আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে এখানে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা চালুসহ একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ভিলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেলক্ষ্যে ৮৫০ শয্যা বিশিষ্ট (১৩ তলা) নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন ভবনের ৫ তলা পর্যন্ত স্ট্রাকচারাল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সালে মধ্যে এটির কাজ শেষ হবে।’চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল

এদিকে হাসপাতালটি শুধু চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে তা নয়, চিকিৎসকও তৈরি করে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে এমবিবিএস কোর্স চালু করার পর এই পর্যন্ত এই হাসপাতাল থেকে ৫টি ব্যাচ সফলতার সাথে এমবিবিএস সম্পন্ন করে বের হয়েছেন। আরও পাঁচটি ব্যাচ অধ্যয়ণরত আছেন। এ বছর ১১তম ব্যাচের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ডা. অধ্যাপক ফজলুল করিম বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সফলতার সঙ্গে ৫টি এমবিবিএস ব্যাচ বের হয়েছে। সবাই তাদের কর্মক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হাসপাতাল কলেজের তালিকায় একেবারে শীর্ষের দিকে অবস্থান করছে। আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে চাই।’

স্থানীয় সাংসদ এম এ লতিফ জানান, ‘এটা একটা ভালো উদ্যোগ ছিল। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ এগিয়ে এসেছেন বলে এই উদ্যোগ সফল হয়েছে। হাসপাতালটি এখন প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সামনে এ হাসপাতাল আরও বড় পরিসরে কাজ করবে এমনটাই প্রত্যাশা।’

/এফএস/ 

আরও পড়ুন- 
বাজেটে ১২ চ্যালেঞ্জ

‘ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণে সব তথ্য পেয়েছি’