বাড়ি ফেরা হলো না শরীফের

পাহাড় ধসে নিহত শরীফ

১২ জুন পরীক্ষা শেষে মাকে ফোন করে জানিয়েছিল কালই বাড়ি ফিরছে। কাপড় চোপড় ব্যাগে আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেনও। মাও ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করে রেখেছিল। কিন্তু সেসব আর খাওয়া হলো না শরীফের। পরদিন ঠিকই বাড়ি ফিরলেন কিন্তু লাশ হয়ে। মঙ্গলবার (১৩ জুন) ভোরে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মারা যান শরীফ। পাহাড় ধসে রাঙামাটিতে এখন পর্যন্ত ১১৩ জন নিহত হয়েছেন।  

নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান শরীফ ছিলেন সবার ছোট। বাবা, মা ও বড় দুই ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করবে, পরিবারের হাল ধরবে সে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই তা ভেঙে গেল।

রাঙামাটি কলেজের স্নাতক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন শরীফ। ভেদভেদির নতুন পাড়ায় নবী ড্রাইভারের বাড়িতে লজিং মাস্টার থাকতেন তিনি। মঙ্গলবার রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের দিন সেহেরি খাওয়ার পর নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ভোরে লংগদু উপজেলার গুলাশাখালীতে নিজ বাড়িতে যাওয়ার কথা। ঘুমন্ত অবস্থায় মাটিচাপা পড়েন শরীফ।

রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের খবর শুনে মঙ্গলবার সকাল থেকেই শরীফের বড় ভাই আজিজ ফোন করে ভাইয়ের খবর জানার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাকে বা সে যে বাড়িতে থাকতো তাদের কাউকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ শরীফের সঙ্গে ওই বাড়ির ৬ সদস্যও মাটি চাপা পড়ে নিহত হন।

এর আগে শরীফের দুই ভাই মারা গেছেন। তার এক ভাই বিষ পানে আত্মহত্যা করেন। আরেক ভাই ১৪-১৫ বছর আগে পাহাড়ে গাছ কাটতে গিয়ে গাছচাপা পড়ে নিহত হন। আর শরীফের মৃত্যু হলো মাটি চাপায়। একে একে তিন ছেলের অকাল মৃত্যুতে শরীফের বাবা সৈয়দ আলী ও তার মা পাথর হয়ে গেছেন। ছোট ছেলের মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন তিনি। জ্ঞান ফিরলেই চিৎকারে কেঁদে উঠছেন আর বলছেন, ‘কি নিয়ে বাঁচবো, কাকে নিয়ে বাঁচবো।’

শরীফের স্ত্রী ও ৫ মাসের একটি ছেলে রয়েছে। স্বামী হারানোর শোকে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। ৫ মাসের সন্তানটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। কারণ বাবা হারানো বিষয়টি তার এখনও বোঝারই বয়স হয়নি। স্বপ্ন ছিল তার ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানাবেন, তাও আর দেখে যেতে পারলেন তিনি।

অত্যন্ত কর্মঠ ছিলেন শরীফ। শেষবার রোজা শুরুর আগে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। তখন নিজ হাতে বাড়িতে বাথরুম, কুয়া, আলনা ও অন্যান্য ফার্নিচার বানান। সেগিুলো দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বড় ভাই আজিজুল। তিনি জানান, তার ভাইট বাড়িতে একটা আমের বাগানও করেছিল।

গুলাশাখালী রাজনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারি শিক্ষক ফারুক হোসেন বলেন, ‘চোখের সামনে শরীফকে বড় হতে দেখেছি। তার ভাইদের সঙ্গে চলাফেরার সুবাদে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাওয়া হতো। দেখলেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করতো ভাই কেমন আছেন? ভাবতেও পারছি না যে ছেলেটিকে আর কোনোদিন দেখবো না। এই পরিবারকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

 /এসটি/