পেশা পরিবর্তনে বাধ্য করছে করোনা

করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বন্ধ রয়েছে খাগড়াছড়ির এই হোটেলইমরান হোসেন মাসুদ, পেশায় আইনজীবীর সহকারী। খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কর্মরত ছিলেন গত এক দশক ধরে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই চলছিল। কখনও বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়নি তাকে। কিন্তু করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। প্রথম দুই মাস কোনোরকম চললেও তারপর পরিবারের ভরণ-পোষণে কষ্ট হচ্ছিল তার। এই পরিস্থিতিতে সরকারি দশ টাকা দরের চালের একটি কার্ডে দুই বারে ৪০ কেজি চাল উত্তোলনও করেন তিনি। তবে শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে মাসুদ বেসরকারি একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছেন।

মাটিরাঙা উপজেলার হোটেল ব্যবসায়ী মামুনুর রশিদ, করোনাভাইরাসের কারণে টুরিস্ট না থাকায় এবং হোটেল বন্ধ থাকায় চার সদস্যের পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েন। বাধ্য হয়ে বিকল্প একটি কুলিং কর্নার চালু করেছেন এবং সেই ব্যবসা থেকে কোনোরকম পরিবার চালিয়ে নিচ্ছেন।

দিঘীনালার চন্দ্র ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি শহরের একটি বেসরকারি হোটেলে হোটেল বয় হিসেবে চাকরি করতেন। করোনায় থাবায় বন্ধ হয়ে গেছে হোটেল। তাই মালিক তাকেসহ আরও ১৫ জনকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা ছাড়াও আছে ছোট দু’ভাই-বোন। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে এখন কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকের।

বিভিন্ন উপজেলার নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এভাবে গত চার মাসে খাগড়াছড়ি জেলার ৯ উপজেলার কয়েকশ' লোক পেশা পরিবর্তন করেছেন। ওপর এক হাজারেরও বেশি প্রবাসী ফেরত এসে কর্মহীন জীবন যাপন করছেন। যারা পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বেশিরভাগ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন এবং স্থানীয় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কর্মহীন জীবন যাপন করছেন।

করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বন্ধ রয়েছে খাগড়াছড়ির এই হোটেলখাগড়াছড়ি হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া বলেন, 'খাগড়াছড়ি ও সাজেকে প্রায় ২০৪টি আবাসিক হোটেল-মোটেল ও কটেজ রয়েছে। যেখানে কাজ করতো প্রায় দুই হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। বর্তমানে এ সব হোটেলে প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। প্রায় দুই হাজার ২০০ জন ছুটিতে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়েছেন।'

তিনি বলেন, 'পর্যটক না থাকায় বেশিরভাগ খাবার ও আবাসিক হোটেল বন্ধ রয়েছে। তাই শ্রমিকদের ছুটিতে পাঠাতে মালিকরা বাধ্য হয়েছেন। এভাবে পরিবহন সেক্টরে থাকা অনেক শ্রমিকও কর্ম হারিয়েছেন।' এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'বাস-মিনিবাস, মাইক্রো-জিপ, সিএনজি অটো, মাহেন্দ্র মিলিয়ে প্রায় এক হাজার গাড়ির দুই হাজার থেকে তিন হাজার ড্রাইভার ও শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কাজ নেই বিধায় অনেকে মৌসুমী ফল বিক্রি, ফল পরিবহনসহ নিজেদের ছোট-খাটো অনেক কাজে জড়িয়েছেন।' দ্রুত পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।

পেশা পরিবর্তনকারী মাসুদ-মামুন-চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, 'আমাদের সঙ্গে কাজ করা বেশিরভাগ সহকর্মী এখন গ্রামে চলে গেছেন। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে টিকে থাকার যুদ্ধ করছেন। পরিবারকে দু’মুঠো ভাত ও কাপড় তুলে দেওয়ার জন্য তারা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন।'

খাগড়াছড়িতে যেন শুনশান নিরবতাখাগড়াছড়ি চেম্বার ও কমার্স এর পরিচালক সুদর্শন দত্ত বলেন, 'খাগড়াছড়ি জেলায় কয়েক হাজার লোক করোনার কারণে পেশা পরিবর্তন করেছেন। বিভিন্ন সেক্টরেই কর্ম হারিয়ে অনেকে দুশ্চিন্তায় স্ট্রোক করছেন। আগের মতো খাগড়াছড়ি শহর বা বিভিন্ন সেক্টর সরগরম নেই।' এই বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে প্রশাসনকে কাজ করার অনুরোধ জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস এ ব্যাপারে বলেন, 'করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন শিল্পসহ সব কিছু স্থবির হয়ে আছে। অনেক প্রবাসী ফেরত এসেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনেকে পূর্বের পেশা ছেড়ে নতুন পেশায় জড়াচ্ছেন।'

কর্মহীন লোকের সঠিক পরিসংখ্যান প্রশাসনের জানা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তবে সরকার চেষ্টা করছে সবার পাশে থাকতে। সরকার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক সব পতিত জায়গা চাষাবাদের আওতায় আনার অনুরোধ জানিয়েছি।'