আন্দামানে ভাসছে রোহিঙ্গাদের ট্রলার, টেকনাফ থেকে যায়নি দাবি প্রশাসনের

রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী একটি ট্রলার আন্দামান সাগরে ভাসছে। দুদিন ধরে ট্রলারটি সাগরে দুর্গত অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তাদের উদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির দাবি, ১০ দিন আগে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সাগর পথে রওনা দিয়েছিল। তবে বিষয়টি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবগত নয়। টেকনাফ থানা ও কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের কর্মকর্তারা বিষয়টি অবহিত নন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকও একই দাবি করেছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মাঝিরাও তাদের কোনও সদস্য নিখোঁজ থাকার এখনও দাবি করেননি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের দমন-পীড়নে নিপীড়িত ও বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা সাড়ে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। তাদের নিজ দেশে সসম্মানে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি আপাতত নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। করোনার কারণে সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়ার পর গত তিন মাস ধরে ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়টিই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। ফলে এরমধ্যে নতুন করে জাহাজে ভিন্ন কোনও দেশে যাওয়ার চেষ্টার খবর এখনও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই। অন্তত গত ১০ দিনে এমন দাবি বা তথ্য কোনও পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে আসেনি।

তবে আন্দামান সাগরে একটি জাহাজে চেপে একদল রোহিঙ্গা কী করে গেলো তা নিয়ে  আজ সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) ইউএনএইচসিআরের দাবির পর যথেষ্ট আলোচনা শুরু হয়েছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ট্রলারে থাকা কিছু শরণার্থী মারা গেছে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

এদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ফলে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম থেকে সাগরপথে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার রওনা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি।’   

আন্দামান সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি টেকনাফ থেকে রওনা দেওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেনেছি কয়েকদিন আগেই ট্রলারটিতে পানি ও খাবার শেষ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইঞ্জিন বিকল। তখন থেকে ট্রলারটি সাগরে ভাসছে। তবে ট্রলারে কতজন শরণার্থী রয়েছে তা জানা যায়নি। কিছু রোহিঙ্গা মারা যাওয়ার খবরও পেয়েছি। ফলে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নৌ-সীমানার সকল কর্তৃপক্ষকে আমরা তথ্যগুলো জানিয়ে রেখেছি এবং তাদের আহ্বান জানাচ্ছি দ্রুত মানবিক সহায়তা করার জন্য। এ মুহূর্তে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের জীবন বাঁচানো সম্ভব।’

ইউএনএইচসিআর বলছে, তারা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশের সরকারকে সহায়তা দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে, যেন জনস্বাস্থ্যের সকল নীতি (পাবলিক হেলথ প্রটোকল) মেনে এই দুর্গত যাত্রীদের তীরে অবতরণে মানবিক সাহায্য প্রদান করা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘বিষয়টি আমরা শুনেছি, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ জানান, ‘আন্দামান সাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারের খবর শুনেছি। এই মুহূর্তে আমরা নিশ্চিত না যে তারা কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়েছিল কিনা। তবু এ বিষয়ে আমরা মাঝিদের ক্যাম্পে খোঁজ-খবর নিতে বলেছি।’ 

টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মো. ইয়াছিন জানান, ‘অনেকে জানতে চেয়েছেন তার ক্যাম্পে কোনও রোহিঙ্গা নিখোঁজ আছে কিনা অথবা সাগর পথে কেউ পাড়ি দিয়েছেন কিনা। এরপর ক্যাম্পে খোঁজ নেওয়ার শুরু করেছি। এখনও কারও নিখোঁজ থাকার খবর পাইনি। অন্য ক্যাম্পগুলোতেও খোঁজ-খবর চলছে। ’

এদিকে, গত ১০ দিন বা তারও আগে টেকনাফ থেকে কোনও নৌযান অবৈধভাবে সাগরে যাত্রা করার কোনও সংবাদ অবহিত নন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, টেকনাফ থেকে সাগরপথে কোনও রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার যায়নি। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কেউ নিখোঁজ আছে বা পালিয়ে বা গোপনে চলে গেছে, এমন দাবি করা হয়নি। সরকারি কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিগতভাবেও কেউ এমন তথ্য দেয়নি থানায়। ফলে এমন কোনও ঘটনা অবহিত নই।

একই কথা বলেছেন কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার অবৈধভাবে সাগরে যাওয়ার কোনও খবর কোস্টগার্ডের কাছে নেই।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘কীভাবে ইউএনএইচসিআর নিশ্চিত যে ট্রলারটি টেকনাফ থেকে গেছে? এমনও হতে পারে ট্রলারটি মিয়ানমার থেকে রওনা দিয়েছিল।’

তিনি জানান, ‘দেশের সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে থাকায় এখান থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার যাওয়ার সুযোগ নেই। কীভাবে ইউএনএইচসিআর নিশ্চিত যে ট্রলারটি টেকনাফ থেকে গেছে। তবু বিষয়টি আমরা দেখছি।’

রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছিল করোনা মহামারি শুরুর প্রথম দিকে গত বছরের ১৫ এপ্রিল। তখন বাংলাদেশ সরকারের সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাগরে যাওয়া রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে টানা দুই মাস সাগরে দুর্বিষহ দিন কাটায়। বাংলাদেশ গ্রহণে রাজি না থাকলেও বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার বিশেষ অনুরোধে তাদের ভাসানচরে আশ্রয় দেয়। তবে তখনই আর কোনও রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে সময় টেকনাফ সৈকতের জাহাজপুরা ঘাট থেকে প্রায় ৪শ' রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছিল কোস্টগার্ডের সদস্যরা।

এদিকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে, যা ২০১৩-১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্র যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু।