নোয়াখালী মুক্ত দিবস আজ

আজ ৭ ডিসেম্বর, নোয়াখালী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিতাড়িত হয়। জেলা শহর মাইজদী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে নোয়াখালীর মাটিতে উড়িছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

২৫ মার্চের পর প্রায় এক মাস ধরে নোয়াখালীকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। পদে পদে বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা ২৩ এপ্রিল নোয়াখালী জেলা শহরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কয়েক দফায় সদরের সোনাপুর, শ্রীপুর, গুপ্তাংক, রামহরিতালুক, বেগমগঞ্জের কুরীপাড়া, গোপালপুর ও আমিশাপাড়ায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। 

এ সময় হানাদার বাহিনী গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করে প্রায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। 

এরপর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে মাঠে নামে পাক হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। কোম্পানীগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নম্বর স্লুইস গেট, সদরের উদয় সাধুর হাট (ওদারহাট), করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পোল, রাজগঞ্জ ও বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা।  

নোয়াখালীকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত, ঠিক তখনই ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানিরা। এ সময় বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কের বগাদিয়া সেতু অতিক্রম করতেই সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীর হামলায় অসংখ্য পাকসেনা ও মিলিশিয়া মারা যায়। 

সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন, মিয়া মো. শাহজাহান, মমতাজুল করিম বাচ্চু ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন বলেন, ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত অপারেশন শুরু করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা সংলগ্ন টেকনিক্যাল হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প মুক্ত করি। একই দিন সকাল ৯টার মধ্যে জেলা শহর মাইজদী বাজার ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, নাহার মঞ্জিল, রৌশনবাণী সিনেমা হল, দত্তেরহাট ও সোনাপুর কোল্ড স্টোরেজের রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। সকাল থেকে পাকসেনা ও রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি মাইজদি পিটিআই থেকে থেমে থেমে গুলি বর্ষণ করলে মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। সন্ধ্যায় চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে মাইক দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে পিটিআই ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থানরত রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে পার্শ্ববর্তী সরকারি আবাসিক এলাকার এক ব্যক্তি মারা যান। পাল্টা গুলি চালায় মুক্তিযোদ্ধারাও। গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো শহর। 

রাজাকাররা আত্মসমর্পণ না করলে, ফেনী থেকে মর্টার শেল এনে নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম দুটি মর্টার শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তৃতীয়টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। মর্টার শেলের শব্দে কেঁপে ওঠে শহর। বিপরীত দিক থেকে আসা গুলি বন্ধ হলে, ক্যাম্পের ভেতরে ১০-১২ জন রাজাকারের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কয়েকজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এভাবে শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে মুক্তিকামী জনতা। শহরের কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওড়ানো হয় জাতীয় পতাকা।  

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন বলেন, দিবসটি উপলক্ষে আজ মাইজদী পিটিআই সংলগ্ন মুক্ত স্কয়ারে বিকাল ৩টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।