মাত্র দশ মাসের মাথায় কুমিল্লার দাউদকান্দি-চান্দিনা সার্কেলের জনপ্রিয় পুলিশ কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জুয়েল রানাকে সিলেটে বদলি করা হয়েছে। সম্প্রতি নানা ইস্যু নিয়ে তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সর্বশেষ চৌদ্দগ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা সভায় দেওয়া তার একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়। স্থানীয়দের ধারণা, এই বক্তব্যের কারণেই তাকে বদলি করা হয়েছে।
রবিবার এক প্রজ্ঞাপনে সপ্তম এপিবিএন সিলেটের সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে তাকে বদলি করা হয়। গত ১০ মাস আগে তিনি কুমিল্লায় যোগদান করেছিলেন।
ইউপি নির্বাচন নির্বাচন নিয়ে ভাইরাল হওয়া বক্তব্যে জুয়েল রানা বলেন, ‘আপনি নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বলেই চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন বিষয়টি এমন নয়। আমি যেখানে ডিউটি করেছি নৌকা পেয়েছে ২৫১ ভোট। কিন্তু নৌকার প্রার্থী বলতে পারেননি ভোট সুষ্ঠু হয়নি। শুধু নৌকা নিয়ে আসলেই, টাকা পয়সা থাকলেই, বড় বড় নেতার আত্মীয়-স্বজন হলে এই নির্বাচনে জয় লাভ করা যাবে না৷ ভোট কেন্দ্র অনেকে দখল করতে আসে, চোর ধর্মের কথা শোনে না! কুত্তার লেজ সোজা হয় না। আমাদের অস্ত্র রেডি আছে, প্রশিক্ষণ আছে, সরকার গুলি দিয়েছে। অর্ডার আছে। আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। আমরা কি বসে থেকে ফিডার খাবো? গুলি করবো। হাত-পা যদি দুই-চার জনের উড়ে যায়, আমাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।’
এএসপি জুয়েল রানা কুমিল্লায় যোগদানের ১০ মাসের মধ্যে নানা কর্মকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বিশেষ করে, ইভটিজিং ও মহাসড়কে ডাকাতি রোধে তার প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল। এ ছাড়াও মেঘনা উপজেলার একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষ চলাকালে তাকে ড্রোন ব্যবহার করে অপরাধীদের শনাক্ত করতে দেখা যায়।
এ ছাড়াও গোমতী নদীতে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, ডাকাতি বন্ধ করে নিরাপদ নৌপথ ঘোষণা করা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে মাধ্যমে আসহায় প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। সম্প্রতি চান্দিনায় বেতন-ভাতার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন শ্রমিকরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন অবরোধ সরাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন এএসপি জুয়েল রানার বক্তব্য শুনে আশ্বাস পেয়ে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে দেয়।
দাউদকান্দির বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজের উদ্বোধনের কথা ছিল জুয়েল রানার। কিন্তু তার আগেই তিনি এখান থেকে বদলি হন। মানুষের পাশে থেকে কাজ করার জন্য ও এলাকাকে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাং মুক্ত করার জন্য দাউদকান্দির বাশরা, হাটখোলা, চাপাতলি, লাখাইতলি ও খৈরখোলা গ্রামবাসী এএসপি জুয়েল রানাকে দিয়েছে সম্মাননা স্মারক।
তার আকস্মিক বদলিকে অনেকে ভিন্নভাবে দেখছেন। দাউদকান্দি উপজেলার পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানুষ কথাও বলতো না। অথচ জুয়েল রানা আসার পর থেকে সাধারণ মানুষের ভিড় দেখা যেতো তার কার্যালয়ে। তিনি সবার কথা শুনতেন। সব অনুষ্ঠানে যেতেন। দাউদকান্দির মানুষ এখন হতাশায় আছে, কারণ তার মাধমে একটা বড় পরিবর্তন আশা করেছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তাকে বদলি করা হয়েছে। তিনি যে পরিবর্তন এই দশ মাসে এনেছেন তা আগের কোনও পুলিশ কর্মকর্তা পারেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুয়েল রানা নিজে থেকে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে এসে আমাকে বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা বন্ধে আমাদের সাহায্য করবেন। পরে আমরা বিভিন্নভাবে অভিযান চালিয়ে দাউদকান্দি থেকে এসব বন্ধ করেছি। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এএসপি জুয়েলরানা ছিলেন দাউদকান্দি-চান্দিনার সন্ত্রাসীদের জন্য একটা আতঙ্ক।’
জাহিদ আলম ইমন নামের একজন ফেসবুকে মন্তব্য করেন, ‘দাউদকান্দির মাটিতে ২৮ নভেম্বর (রবিবার) ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনটি হয়েছে স্মরণকালের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। আর এই শ্রেষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম কারিগর হলেন কুমিল্লা জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এএসপি জুয়েল রানা। দাউদকান্দির জনসাধারণের জন্যে এমন সুন্দর, মনোরম ভোটের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ায় জুয়েল রানা স্যারকে দাউদকান্দিবাসীর পক্ষ থেকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। দাউদকান্দির মাটিতে আপনার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রবে।’
মিজানুর রহমান হৃদয় নামের একজন ফেসবুকে লেখেন, ‘কুমিল্লার দাউদকান্দি জোনের এএসপি জুয়েল রানা সাহেবের সাম্প্রতিক কিছু ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাস আদায়ে তার শক্ত অবস্থান। এ ছাড়া চলমান ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কথা জানান দেন। সেখানে তিনি সব প্রার্থীর উদ্দেশে বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বলে জয়ী হবেন এটা ভুলে যান’। এরপর তাকে হঠাৎ করে সিলেটে বদলি করা হলো। আমরা সাধারণ মানুষের দাবি জানাই, অবিলম্বে এএসপি জুয়েল রানা সাহেবকে তার আগের কর্মস্থলে বহাল রাখতে হবে।’
বদলি ও সামগ্রিক বিষয়ে এএসপি জুয়েল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা জনস্বার্থে বদলি। এ ছাড়া আমি কিছুই বলতে চাই না। এমনিতে বিপদের মধ্যে আছি ‘
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সরকারের কাজ করি। আমরা ভালো কাজ করলে সরকারের সুনাম বৃদ্ধি হয়। এখন সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমাদের আর কী করার! আমি কুমিল্লা নয়, যেখানে গিয়েছি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য চেষ্টা করেছি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করেছি। আর কুমিল্লায় কাজ করে আমার কাছে ভালো লেগেছে। এখানকার গ্রামেগঞ্জে রত্ন পড়ে থাকে। এখানকার মানুষ খুবই ভালো। পুলিশিং শেখার জন্য এটা বেস্ট জায়গা।’
উল্লেখ্য, করে ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ পুলিশের ২০১৯-২০ বছরের জন্য জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ সার্কেল এএসপির পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ জনবান্ধব কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছিলেন এএসপি মো. জুয়েল রানা।