একজনের জবানবন্দি, কক্সবাজারের ১২ সার্ভেয়ারকে একযোগে বদলি

ঢাকার বিমানবন্দরে সাড়ে ২৩ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ঘটনায় গত ১৭ জুলাই কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ১২ সার্ভেয়ারকে একযোগ বদলি করা হয়েছে।

বদলি করা সার্ভেয়াররা হলেন- জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মো. সাইফুল ইসলাম, দুলাল খান, ইব্রাহিম ফয়সাল, মির্জা মোহাম্মদ নূরে আলম, হযরত আলী, মো. আব্দুল কাইয়ুম, শরিফুল ইসলাম, জিয়াউর রহমান, মো. নুর উদ্দিন আলম, সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলম, চকরিয়া ভূমি কার্যালয়ের সাখাওয়াত হোছাইন ও রামু ভূমি কার্যালয়ের মাহমুদুল হাসান।

জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারে মেগা প্রকল্প ঘিরে ভূমি অধিগ্রহণে প্রকাশ্যে কমিশন বাণিজ্য অব্যাহত আছে গত সাত বছরের বেশি সময় ধরে। যার জের ধরে একজন সাবেক জেলা প্রশাসক, বেশ কয়েকজন সার্ভেয়ার গ্রেফতার ও মামলার আসামি হলেও কমিশন বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। বরং নতুন কৌশলে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র কমপক্ষে ছয় শতাংশ থেকে শুরু করে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন আদায় অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে ১ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দরে সাড়ে ২৩ লাখ টাকাসহ ধরা পড়েন সার্ভেয়ার আতিকুর। তাকে কক্সবাজার ফিরিয়ে আনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়ে থানায় সোপর্দ করেন। ওই অভিযোগটি জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করে ৫৪ ধারায় আতিকুরকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

সার্ভেয়ার আতিকুরকে থানায় সোপর্দ করতে যে জিডি করা হয়েছে তা দুনীর্তি দমন কমিশনের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। যার সূত্র ধরে আতিকুরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলায় আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে আতিকুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ১৯ জুলাই আতিকুরকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. আবুল মনসুর সিদ্দিকীর কাছে হাজির করা হয়। বিচারকের কাছে সার্ভেয়ার আতিকুর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের আইনজীবী আবদুর রহিম।

তিনি মামলার তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে আদালতের একটি সূত্র জানিয়েছে, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের একাংশ গড়ে উঠছে ধলঘাটা ইউনিয়নে। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য ওখানে রয়েছে দালাল চক্র। বন্দরের জন্য অধিগ্রহণকৃত ৩১৫ একর জমির একরপ্রতি ক্ষতিপূরণের টাকা নির্ধারণ করা হয় ৫৫ লাখ টাকা করে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের চেক নিতে গিয়ে জমির মালিকদের দালালের মাধ্যমে সার্ভেয়ারকে কমিশন দিতে হচ্ছে ২০ শতাংশ করে। কমিশন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কে কত শতাংশ ভাগ নেন তা জবানবন্দিতে জানিয়েছেন আতিকুর। ফলে অনেকে ফেঁসে যেতে পারেন।

এদিকে, সার্ভেয়ার আতিকুর জবানবন্দি দেওয়ার পর কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কর্মরত ১২ সার্ভেয়ারকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ১২ সার্ভেয়ারকে কক্সবাজারে সংযুক্ত করা হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ বলেন, সাড়ে ২৩ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার আতিকুরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশপাশি দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দুর্নীতি ঠেকাতে জেলায় কর্মরত ১২ সার্ভেয়ারকে একযোগে বদলি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বদলি হওয়া সার্ভেয়াররা এখনও কক্সবাজার রয়েছেন। নতুন সংযুক্ত করা কর্মকর্তারা আসেননি। তবে আগামী ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে নতুনদের কাজে যোগদান করতে হবে এবং বদলিকৃতদের কক্সবাজার ছাড়তে হবে।

দুদকের তথ্যমতে, কক্সবাজারে ৭৩টি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। যার ব্যয় তিন দশমিক পাঁচ লাখ কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রয়োজনে ২৫ হাজার কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণ চলমান। হাজার হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প ঘিরে কক্সবাজারে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। ভূমি অধিগ্রহণের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। ১৫ শতাংশ ঘুষ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতে পান না ভূমির মালিকরা। ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে সেখানে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দালালদের পকেট ভারী হচ্ছে।

২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়ার ছড়ায় সার্ভেয়ার ফেরদৌসের বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৭ লাখ টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব। এছাড়া বাহারছড়া এলাকায় সার্ভেয়ার ফরিদের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলাগুলো তদন্ত করছে দুদক। এরই মধ্যে দুদকের তিনটি তদন্তে ভূমি অধিগ্রহণে ৭৮ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে ২০১৭ সালে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মের জন্য সাবেক জেলা প্রশাসক রুহুল আমিনকেও কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।