জিজ্ঞাসাবাদে ‘দম্ভ’ দেখিয়েছে আয়াতকে ৬ টুকরো করা আবির

চট্টগ্রামে নৃশংসভাবে খুন হওয়া শিশু আলিনা ইসলাম আয়াতকে (৫) অপহরণের পর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ঘাতক আবির আলীর (১৯)। এ জন্য কিনেছিল নতুন সিম এবং পুরান মোবাইল ফোন। তবে ওই মোবাইল ফোনে সচল হয়নি সিমটি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিপণ দাবি না করে নীরব ছিল এই ঘাতক। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদেও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ‘দম্ভ’ দেখিয়েছে এই খুনি।

এই খুনের ঘটনাটি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ভুক্তভোগী নগরের ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা নয়াহাট এলাকার শাহেদা ইসলাম তামান্না ও সোহেল রানা দম্পতির একমাত্র সন্তান।

যেভাবে ঘটনার শুরু

গত ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা নয়াহাট বিদ্যুৎ অফিস এলাকার মসজিদে প্রতিদিনের মতো আরবি পড়তে যাচ্ছিল আয়াত। ওই মসজিদে এলাকার অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আসরের নামাজের পর আরবি পড়ানো হয়।

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে একবার আয়াতকে কোলে নিয়েছিল আবির। তখন দেখে ফেলে আয়াতের সহপাঠী আসমিন। এ কারণে তাকে ছেড়ে দেয়। পরে পেছন থেকে ডেকে নিয়ে যায় আবির। আয়াত কাছে আসা মাত্র তাকে চেপে ধরে আবিরের বাবার ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে লুঙ্গি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। লাশ একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে সেখান থেকে নিয়ে যায় মায়ের বাসায়। দুই বাসার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এখানে উল্লেখ্য, গত কয়েকমাস ধরে আবিরের মা-বাবা আলাদা থাকছেন।

পিবিআই ইন্সপেক্টর মো. ইলিয়াছ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লাশভর্তি বস্তাটি মায়ের বাসায় আনার পর প্রথমে শৌচাগারের ওপর ফাঁকা জায়গায় রাখে। সেখান থেকে আবারও আয়াতের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে সেও খোঁজাখুঁজি করে। পরে রাত সাড়ে ১০টায় পুনরায় মায়ের বাসায় আসে। সেখানে মাকে বলে, আয়াতকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আমিও বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছি। দীর্ঘদিন তাদের বাসায় ছিলাম, একটু গিয়ে তার মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে আসো। এই বলে মা এবং বোনকে ওই বাড়িতে পাঠায়। এদিকে ফাঁকা বাসায় আবির লাশ ছয় টুকরো করে। টুকরোগুলো দুটি বস্তায় ঢুকিয়ে এক বেড়িবাঁধ এলাকায় বঙ্গোপসাগরে অপর বস্তা স্লুইস গেটের মুখে ফেলে দেয়।’

নিহত আয়াতের দাদা মঞ্জুর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশে একটি ভাড়া ঘর রয়েছে। ওইখানে ২১ বছর ধরে আবির আলীর পরিবার বসবাস করেছে। মাঝখানে দুই বার বের হয়ে অন্যখানে গেলেও ৪-৫ মাস পর আবার চলে আসে। দীর্ঘদিন আমার বাসায় থাকার কারণে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকি আবির আলীর জন্মও হয়েছে আমাদের বাসায়। গত আট মাস আগে আবিরের মা আলো বেগম ও বাবা আজমল আলী পৃথক হয়ে যায়। এর পর আজমল আলী আমার ভাড়া ঘরে থেকে গেলেও মা প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ইপিজেড থানাধীন আকমল আলী এলাকায় নতুন করে ঘর ভাড়া নেয়। সেখানে মা ও ছোট বোনকে নিয়ে বসবাস করতো আবির। তবে তার বাবার বাসায়ও প্রায় আসা-যাওয়া করতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে পুরো ঘর মাতিয়ে রাখতো আয়াত। আমার একমাত্র নাতনিকে এভাবে হারাতে হবে তা বুঝিনি। আমি নাতনি হত্যার বিচার চাই। নাতনিকে যে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তার ফাঁসি চাই।’

পিবিআই ইন্সপেক্টর ইলিয়াছ খান বলেন, ‘গত ১৫ নভেম্বর বিকালে আয়াত নিখোঁজের পর ইপিজেড থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার বাবা। ইপিজেড থানা পুলিশ এ নিখোঁজ ডায়েরি তদন্ত করে। পাশাপাশি পিবিআই ছায়া তদন্ত করে। মামলা তদন্তের এক পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় আবির বাজার ব্যাগে কী যেন নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে তাকে বৃহস্পতিবার রাতে বাসা থেকে আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আয়াতকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ ছয় টুকরো করে সাগরে এবং স্লুইস গেটের মুখে ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করে।’

পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবির হত্যার দায় স্বীকার করার পর পিবিআই কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, আমিতো সব এভিডেন্স নষ্ট করে দিয়েছি। কিছুই তো রাখিনি। যেগুলো দিয়ে আপনারা আমাকে ফাঁসাতে পারবেন। দেড় মাস আগে আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে আবির। সে ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রল ও সিআইডির নিয়মিত দর্শক। আলামত নষ্ট ও হত্যার কৌশল এসব সিরিয়াল থেকে রপ্ত করেছে বলেও আবির জানায়।’

অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) নাইমা সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আয়াত হত্যার ঘটনায় একমাত্র আসামি আবির আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবির হত্যার বিষয়টি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। এ আবিরকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়। এদিকে খুনের ঘটনায় শুক্রবার রাতে মামলা হয়েছে। নিহতের পিতা সোহেল রানা বাদী হয়ে এ মামলা করেন। তবে মামলায় কোনও আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আসামি গ্রেফতারের পরও তার নাম উল্লেখ না করায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ইপিজেড থানার ওসি আবদুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিহতের বাবা মামলা করেছে। মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। কেন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তা তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই ভালো বলতে পারবে।’

তবে পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনও সমস্যা নেই। তদন্ত করে প্রতিবেদনের আসামির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।