পুলিশকে বলেছি আমার মায়ের দুটি কিডনি নষ্ট, তবু কারাগারে পাঠালো

‘আমি পুলিশকে কোনও ধরনের মারধর করিনি। অথচ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এসব অভিযোগের মামলায় আমাকে চার দিন কারাগারে রাখা হয়েছে। আমার অপরাধ কী? কেন আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে? আমি তো শুধু আমার মায়ের ডায়ালাইসিস ফি কমানোর দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছি।’

রবিবার (১৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টায় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এসব কথা বলেছেন মো. মোস্তাকিম (২২)। এর আগে রবিবার দুপুরে শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২-এর বিচারক মো. অলিউল্লাহর আদালত মোস্তাকিমের জামিন মঞ্জুর করেন।

মোস্তাকিমকে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট ফাউন্ডেশন (বিএইচআইএফ)। কিডনি রোগী মায়ের ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি।

মোস্তাকিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মায়ের দুটি কিডনি নষ্ট। সাত বছর আগে আমার মায়ের কিডনি রোগ ধরা পড়ে। ছয় বছর ধরে ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে মায়ের। সপ্তাহে তিন দিন করে মাসে ১২ দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। ১ জানুয়ারি থেকে ডায়ালাইসিস ফি অনেক বাড়ানো হয়েছে। ফি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দাবি জানিয়েছি মাত্র। কেননা আমাদের মতো গরিব মানুষের পক্ষে এত টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস করানো কষ্টকর।’

মোস্তাকিম বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসায় ফাজিল শেষ বর্ষে পড়ছি। পাশাপাশি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে অনার্স শেষ বর্ষে আছি। এর বাইরে আমি তিনটি টিউশনি করি। আমার লেখাপড়ার খরচ আমি নিজেই জোগাড় করি। পাশাপাশি মায়ের ওষুধ খরচ যতটুকু পারি দিচ্ছি। বাকি টাকা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নিচ্ছি। অনেক আত্মীয়স্বজন আমার মাকে সহযোগিতা করে থাকেন। এভাবে আজ ছয় বছর ধরে চলছে।’

মোস্তাকিম বলেন, ‘পুলিশ যখন আমাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়, তখন পুলিশকে বলেছি, আমার মা ও এক প্রতিবন্ধী বোনের আমি ছাড়া কেউ নেই। অসুস্থ মা আমাকে ছাড়া অচল। তার শরীরের অবস্থা একেক সময় একেক রকম হয়। তার ওপর সপ্তাহে তিন দিন তার ডায়ালাইসিস করাতে আমাকে নিয়ে যেতে হয়। পুলিশকে অনেক বুঝিয়েছি, তারা আমার কথা শোনেনি। বানোয়াট মামলায় আমাকে আসামি করে কারাগারে পাঠিয়েছে। আমি এর বিচার চাই। তদন্ত করে দোষী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’

মোস্তাকিমের অসুস্থ মা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে এমন কী অপরাধ করেছে, তাকে পুলিশ কারাগারে পাঠিয়েছে? ছেলেকে ছাড়া আমি অচল। আমার স্বামী ২০১৪ সালে মারা গেছেন। আমার এক ছেলে ও ১০ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে দুঃখ-কষ্টে চলছি। আমার দুটি কিডনি নষ্ট। সপ্তাহে তিন দিন করে মাসে ১২ দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয়।’

১ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে ডায়ালাইসিসের ফি। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণকারী রোগী ও তাদের স্বজনরা। আন্দোলন থেকে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে করা মামলায় মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) গ্রেফতার হন মোস্তাকিম। তিনি নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন জালালাবাদ অক্সিজেন এলাকার মৃত খালেদ আজমের ছেলে।

গত কয়েকদিন ধরে ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণকারী রোগী ও তাদের স্বজনরা

নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমার মাসে ১২ বার ডায়ালাইসিসের মধ্যে আট বার করা হতো ভর্তুকিতে ৫১০ টাকা করে। বাকি চারবার করা হতো ভর্তুকি ছাড়া দুই হাজার ৭৮৫ টাকায়। তবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে হঠাৎ বাড়িয়ে দেওয়া হয় ডায়ালাইসিস ফি। আগে যেখানে ভর্তুকিতে ৫১০ টাকা ছিল, তা করা হয় ৫৩৫ টাকা। ভর্তুকি ছাড়া নতুন ফি নির্ধারণ করা হয় দুই হাজার ৯৩৫ টাকা। আগে পুরো মাসে ভর্তুকিতে আটটি ডায়ালাইসিস করানো হলেও এবার ছয়টির সিরিয়াল পাওয়া গেছে। তার মানে মাসে ১২টির মধ্যে ছয়টি ভর্তুকি ছাড়া দিতে হবে। এতে খরচ পড়বে মাসে ২০ হাজার ৮২০ টাকা। এই টাকা আমার মতো দরিদ্র মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।’

মোস্তাকিমকে গ্রেফতারের পর পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন। মোস্তাকিমকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তার নাম উল্লেখ করে এই মামলায় আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৫ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৩১টি মেশিন নিয়ে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেসরকারি অংশীদারত্বের চুক্তি অনুযায়ী ‘স্যান্ডো’ নামে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের চুক্তিতে সেখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে।