সবজি চাষে শফিউলের বছরে আয় ৬ লাখ টাকা

ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না শফিউল বশর। ক্রাচে ভর করে চলতে হয়। কিন্তু এই প্রতিবন্ধিতা তাকে দমাতে পারেনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে সফল হয়েছেন। সবজি চাষে ভাগ্য বদল করেছেন। দুই ছেলেকে বিএ পাস করিয়েছেন। এখন ছেলেরাও বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেন। সবজি চাষই তার জীবনযাত্রায় গতি এনেছে। উৎপাদিত সবজি বিক্রি করে বছরে ছয়-সাত লাখ টাকা আয় করছেন। ফলে স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছে তার পাঁচ সদস্যের পরিবার।

শফিউল বশর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার গোমতি ইউনিয়নের বান্দরছড়া গ্রামের বাসিন্দা। সবজি চাষ করে ইতোমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন সেরা কৃষকের স্বীকৃতি।

নিজের সবজি ক্ষেতে কাজ করছেন শফিউল বশর

শফিউল বশরের সফলতার কথা ভালোভাবেই জানেন গোমতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তোফায়েল আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘সুস্থ হয়েই জন্ম নিয়েছিলেন শফিউল। ১৯৯৬ সালে প্রতিবেশীর ঘরে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে দগ্ধ হন। এতে বাঁ পায়ে দেখা দেয় সংক্রমণ। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েও ভালো না হওয়ায় ২০০১ সালে পা কেটে ফেলতে হয়। তখন থেকেই ক্রাচে ভর করে চলছেন। পা কাটার পর দুই বছর ঘরে বসেছিলেন। নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় পড়েন। এ অবস্থায় সবজি চাষ শুরু করেন। তাতেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় শফিউলের।’

কৃষিকাজ শুরুর কথা জানিয়ে শফিউল বশর বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ার পর জীবন অচল হয়ে পড়েছিল। তবে আশা হারাইনি। ২০০৩ সালে নিজের ১০ শতক জমিতে সবজি চাষের মাধ্যমে কৃষিকাজ শুরু করি। ভালো আয় হওয়ায় অন্যদের কাছ থেকে আরও ৯ বিঘা জমি বর্গা নিই। সেখানে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করি। গত ২০ বছরে আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে সবজি চাষ।’

বর্তমানে সবজি ক্ষেতে ১০ শ্রমিক কাজ করে সংসার চালান উল্লেখ করে শফিউল বলেন, ‘এসব শ্রমিককে ভালো মজুরি দিই। সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে ছয়-সাত লাখ টাকা আয় হয় আমার। সংসার চলছে ভালোভাবেই।’

শফিউল বশরের সবজি ক্ষেতে কাজ করছেন শ্রমিকরা

‘শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলেও ভিক্ষাবৃত্তির চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। বরং কাজ করে সফল হওয়ার ইচ্ছে ছিল। এজন্য পেয়েছি সফল চাষির জাতীয় স্বীকৃতি’ বলছিলেন শফিউল।

একেক মৌসুমে একেক সবজি চাষ করি উল্লেখ করে শফিউল বশর বলেন, ‘লাল শাক, পাট শাক, বেগুন, মরিচ, ঢেঁড়স, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, করলা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, ঝিঙা, ডাটা, পুঁইশাক, বরবটি, শিম ও বেগুন চাষ করি। রবি মৌসুমে বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, আলু, ভুট্টা ও পেঁয়াজ-রসুন চাষ করি। এখন ক্ষেতে আছে ক্ষীরা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচা মরিচ, করলা, টমেটো, আলু ও ভুট্টা।’

তিনি বলেন, ‘সবজি ক্ষেতে সারাদিন সময় দিই। ১০ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। পরিবারের লোকজন চাষাবাদে সহযোগিতা করে। এই সবজি চাষ করে দুই ছেলেকে বিএ পাস করিয়েছি। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।’

শফিউল বশরের বড় ছেলে আবুল বাশার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বাবাকে ক্রাচে ভর করে জমিতে সবজি চাষ করতে দেখছি। যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করতাম। পাশাপাশি স্কুলে পড়তাম। লেখাপড়া শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করছি। বাবার মনোবল আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।’

শফিউল বশরের ক্ষেতের আলু

প্রতিবন্ধিতাকে হার মানিয়ে সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন শফিউল এমনটি জানালেন জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তা মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘শফিউলকে দেখে এলাকার মানুষজন চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে অনেকে শাকসবজি চাষ করছেন।’

উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘চাষাবাদে কীভাবে সফল হতে হয়, তা দেখিয়েছেন শফিউল। তার সফলতা সবার জন্য অনুপ্রেরণা।’

ইচ্ছা থাকলে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তার উদাহরণ শফিউল এমনটি বলেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘শফিউল একই জমিতে ২০ বছর ধরে একাধিক সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন। সফল চাষি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা তাকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী চাষ করে ভালো আয় করছেন। আমরা তাকে চাষাবাদে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’