মিতু হত্যার সাত বছর, শুরু হচ্ছে সাক্ষ্যগ্রহণ

চট্টগ্রামে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার সাত বছর পূর্ণ হলো আজ বুধবার। ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহিরকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ের কাছে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় ছেলে মাহির প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বর্তমানে মাহির ঢাকার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তার বোন তাবাচ্ছুম তানজিন টাপুরের তখন বয়স ছিল তিন বছর। বর্তমানে তার বয়স ১১ বছর। পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। এ দুই ভাই-বোনের মা মারা গেছেন সাত বছর আগে। মায়ের হত্যার দায় নিয়ে কারাগারে পিতা বাবুল আক্তার। তারা এখন মা-বাবাহীন।

এদিকে, মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার দুই মেয়ের মধ্যে মিতু ছিল বড়। মিতুকে হত্যার আরও একটি বছর চলে গেল। এখনও হত্যায় জড়িত সব আসামি গ্রেফতার হয়নি। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই। যারা আমার মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

তিনি আরও বলেন,‘আমার মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আমার নাতি-নাতনিকে আমার কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে। অনেকগুলো বছর তাদের মুখ আমরা দেখিনি। এখন আমার নাতি মাহির অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তার বয়স ১৪ বছর। মেয়ে তাবাচ্ছুম চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। তার বয়স ১১ বছর। নাতি-নাতনিকে নিজেদের কাছে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পিটিশন মামলা করেছি। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সুরাহা হয়নি।’

বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামী ৯ এপ্রিল আদালতে মিতু হত্যা মামলার তারিখ ধার্য রয়েছে। ওই দিন সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন ওইদিন প্রথম সাক্ষী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগামী ৯ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ রয়েছে। ওই দিন মামলার বাদী হিসেবে আমিই প্রথম সাক্ষ্য দেব। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাইব। আমার মেয়ে হত্যার মূল হোতা বাবুল আক্তারসহ সব আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাব।’

২০১৬ সালের ৫ জুন মিতুকে হত্যার ঘটনায় স্বামী বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরের পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে পাঁচলাইশ থানা-পুলিশ। পরে সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে মামলার তদন্তর ভার পায় সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিতু হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এরপর পাল্টে যায় মিতু হত্যা মামলার গতিপথ। পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে বাবুল আক্তারই মিতু হত্যার মূল আসামি। 

এরপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্টার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। একইদিন ১২ মে বাবুল আক্তারসহ ৮ জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। এ মামলায় বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। রিমান্ড শেষে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার কথা থাকলেও পরে জবানবন্দি দেননি বাবুল।

এরপর গ্রেফতার এহতেশামুল হক ওরফে ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ট সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে জবানবন্দি দেন। এতে মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা আরও জোরালো হয়।

আদালত সূত্র জানায়, মিতু হত্যা মামলায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ সাত আসামির বিরুদ্ধে গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের অতিরিক্ত তৃতীয় মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে শুনানি শেষে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সাত আসামিরা হলেন- মিতুর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার, মো. কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ওরফে ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান। 

এরমধ্যে কারাগারে আছেন বাবুল আক্তার, আনোয়ার হোসেন, শাহজাহান মিয়া ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম। এ মামলায় জামিনে আছেন এহতেশামুল হক ভোলা। অপর দুই আসামি কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা ও মো. খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু ঘটনার পর থেকে তারা নিখোঁজ।

এর আগে গত ১০ অক্টোবর বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তারসহ এই সাতজনকে আসামি করা হয়।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিতু হত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা স্বামী বাবুল আক্তার নিজেই। কিলিং মিশনের প্রধান ছিলেন তার বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন আরেক সোর্স এহতেশামুল হক ভোলা। কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেন কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, খাইরুল ইসলাম কালু, শাহজাহান মিয়া, নুরুন্নবী ও রাশেদ।

এতে আরও বলা হয়, মিতুকে হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া ছয় জনের মধ্যে তিন জন আগে থেকেই ঘটনাস্থলে ছিলেন। মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন মুসাসহ তিন জন। মোটরসাইকেলের চালকের আসনে ছিলেন মুসা, মাঝে নুরুন্নবী ও পেছনে ছিলেন ওয়াসিম। ওয়াসিমই মিতুকে গুলি করেন। দুটি গুলির মধ্যে একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। আরেকটি মিতুর শরীরে লাগে। এরপর নুরুন্নবী, রাশেদ ও কালু ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ সময় মিতুর সঙ্গে তার ছেলে আখতার মাহমুদ মাহির ছিল। তাকে ধরে রেখে হত্যার নির্দেশনা দেন মুসা। হত্যায় অংশ নেওয়া নুরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত গায়ত্রী অমর সিং নামে এক বিদেশি নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কের কথা মিতু জেনে যান। এ কারণে বাবুল তার বিশ্বস্ত সোর্সদের দিয়ে তাকে হত্যা করিয়েছিলেন। ২০১৪-১৫ সালে বাবুল আক্তার মিশনে সুদান যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন বাসায় রেখে যান। ওই মোবাইল ফোনে গায়ত্রী ২৯টি মেসেজ পাঠান। মেসেজগুলো দেখে প্রেমের বিষয়ে জানেন মিতু। বাবুল আক্তার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কক্সবাজারে কর্মরত থাকাকালে ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তা গায়ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

এর মধ্যে ‘তালেবান’ ও ‘বেস্ট কিপ্ট সিক্রেট’ নামে দুটি বই বাবুলকে উপহার দেন গায়ত্রী। বইগুলোতে বাবুলের সঙ্গে তার সাক্ষাতের তারিখ ও স্থান লেখা ছিল। ২০১৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাবুল ও গায়ত্রীর প্রথম দেখা হয় বলে বইয়ে লেখা ছিল। মিতু এই সম্পর্কের বিষয়ে জেনে গিয়ে প্রতিবাদ করলে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন বাবুল। নির্যাতনের বিষয়টি নিজের বাবাকেও জানিয়েছিলেন মিতু।