চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২০২২ সালের ৪ জুন প্রাণ হারান মুবিনুল হক। ১১ মাস কেটে গেলেও ছেলের শোক ভুলতে পারছেন না স্কুলশিক্ষক বাবা ফরিদুল আলম। ছেলের ছবি হাতে প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
২৬ বছরের মুবিনুল দুর্ঘটনার তিন মাস আগে কনটেইনার ডিপোতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী এলাকায়।
শুক্রবার (৫ মে) বিকালে কথা হয় নিহত মুবিনুল হকের বড় ভাই মো. আবদুল্লাহ আল মামুন ফয়সালের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুবিন চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাস করেন। এর পর বিএম কনটেইনার ডিপোতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়। দুর্ঘটনার মাত্র তিনমাস আগেই চাকরিতে যোগ দেয়। তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাও হয়। শিগগিরই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হতো। এরমধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে যান মুবিন।’
তিনি ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে মুবিন বাবাকে ফোন করে বলেন- ‘বাবা ডিপোতে আগুন লেগেছে। আমার এক পা পুড়ে গেছে। বাবা আমি হয়তো বাঁচবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ এ কথা শোনার পর আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। পড়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করি।’
এ ঘটনায় নিহত হন গাড়ি চালক মাঈন উদ্দিন। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার হেমায়েত উল্লাহর ছেলে। হেমায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মাঈন উদ্দিন ছিল সবার বড়। সে অন্য প্রতিষ্ঠানের রফতানি যোগ্য পণ্যবাহী কনটেইনার নিয়ে বিএম ডিপোতে গিয়েছিল। বিস্ফোরণে তার গাড়ি পুড়ে গেছে। মারা যায় আমার ছেলে মাঈন উদ্দিন।’
ছেলের মৃত্যুর জন্য ডিপো কর্তৃপক্ষের কোনও অবহেলা ছিল মনে করেন কিনা? জানতে চাইলে হেমায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমি একজন অটোরিকশা চালক। ডিপো কর্তৃপক্ষের কোনও দোষ থাকলেও আমার মতো মানুষের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে লড়া তো সম্ভব নয়। তবে আমার ছেলের ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পয়সা দিয়েছিল।’
গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। আহতদের চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ৭ জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী বাদী হয়ে ডিপোর আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
মামলায় ডিপোর কর্মচারীদের আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- বিএম ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেড ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলাম।
ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ডিপোতে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনার থাকার কথা ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি মালিকপক্ষ। এ কারণে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারের আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। কেমিক্যালের কারণে এক কনটেইনার থেকে আরেক কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
মামলার এজাহারে পুলিশ আরও উল্লেখ করে, বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অনেক ভবনের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে। বিস্ফোরিত কনটেইনারের ছড়িয়ে পড়া টুকরোর আঘাতে ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ আহত হন। এজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, ডিপো পরিচালনায় দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
প্রথমে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে। পরে জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে এ মামলার তদন্তভার পায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ৩ মে বিকালে চট্টগ্রাম চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী। প্রতিবেদনে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের জন্য কারও দায় পায়নি এ কর্মকর্তা।
বিএম ডিপো সূত্র জানায়, বিস্ফোরণের পর গত নভেম্বর মাসে বিএম কনটেইনার ডিপোর আমদানি-রফতানি পণ্য ব্যবস্থাপনা পুরোদমে শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার পর ডিপো ব্যবহার করে আমদানি-রফতানি ও খালি কনটেইনার সংরক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডিপো সংস্কার করার পর গত ২২ আগস্ট শুধু খালি কনটেইনার সংরক্ষণের অনুমোদন দেয় কাস্টমস। গত ২৫ অক্টোবর নয় শর্তে পোশাকপণ্য রফতানি কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়। শর্ত পরিপালন করায় গত ৭ নভেম্বর আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পুরোদমে শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়।
তবে বিএম ডিপোর রাসায়নিক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপ ও নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠান মিলে বিএম কনটেইনার ডিপো চালু করে।