ধ্বংসের পথে ছেঁড়া দ্বীপের প্রবাল!

অতিরিক্ত পর্যটক, অপরিকল্পিত স্থাপনা আর চরম অব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন অস্তিত্ব-সংকটে পড়েছে প্রবাল দ্বীপ ছেঁড়া দ্বীপ। পর্যটকদের অবাধ চলাফেরা ও স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে হুমকির মুখে রয়েছে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দুর জীববৈচিত্র্য ও প্রবাল। এর পাশাপাশি বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর সমুদ্রের উচ্চতা। ফলে দ্বীপটিকে রক্ষা করা বেশ জটিল হয়ে উঠছে।

সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করা পর্যটকদের কাছে ছেঁড়া দ্বীপ ভ্রমণ যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে লাইফ বোট ও স্পিডবোটে প্রতিদিন শত শত পর্যটক যাচ্ছেন সেখানে। এতে ছেঁড়া দ্বীপ হুমকিতে পড়ছে সামুদ্রিক প্রবাল ও জীববৈচিত্র্য। এসবের পরেও সেন্টমার্টিন ঘিরে প্রভাবশালীদের মৌসুমি ব্যবসা বাড়ছে। রিসোর্ট, রেস্টুরেন্টে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো দ্বীপে।

২০২০ সালের ১২ অক্টোবর সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপ অংশে পর্যটকদের যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সেন্ট মার্টিনে ছয় ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

পর্যটকদের চলাচলে প্রজ্ঞাপন জারি করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

গত ২৩ মে এ ছাড়া প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গত বছরের শেষ দিকে বিভিন্ন বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনও তদারকি নেই স্থানীয় প্রশাসনের।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেন্টমার্টিনের জেটির মাঝামাঝি স্থানে একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। সেখানে ‘স্পিডবোট ও লাইফ বোট’ মালিক সমবায় সমিতির নাম লেখা। পাশাপাশি ছেঁড়া দ্বীপ, প্রবাল দ্বীপে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সাইনবোর্ডে ফোন নম্বর দেওয়া আছে। দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছেঁড়া দ্বীপে যেতে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য টিকিট কাউন্টার।

এ ছাড়া সমুদ্রসৈকত দিয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে (টমটম) চড়ে শত শত পর্যটক ছেঁড়া দ্বীপে যাতায়াত করছেন। তাতে ধ্বংস হচ্ছে বালুচরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, প্রবাল-শৈবালসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

নোঙর করে রাখা স্পিডবোট ও লাইফ বোট, সেগুলো নিচে থাকা কোরালগুলো ক্ষতিক্ষস্ত হচ্ছে

সাইনবোর্ডে দেওয়া নম্বরে কল দিলে নিজেকে আবদুল্লাহ মামুন পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, আমি ‘স্পিডবোট ও লাইফ বোট’ মালিক সমবায় সমিতির পক্ষ থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। ছেঁড়া দ্বীপে যেতে কোনও মানা নেই। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জন পর্যটক ছেঁড়া দ্বীপে যান। জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা নিয়ে পর্যটকদের বোটে করে ছেঁড়া দ্বীপে পৌঁছে দিই, আবার নিয়ে আসি। রিজার্ভ হলে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা নিই। কিন্তু যাওয়ার সরকারি অনুমতি আছে কি না, জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

জানতে চাইলে স্পিডবোট ও লাইফ বোট মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি ও সেন্টমার্টিন ইউপি সদস্য খোরশেদ আলম এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আগে যেখানে ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটারজুড়ে জীবন্ত প্রবাল ছিল, এখন সেখানে আছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৩৯ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ এরই মধ্যে দ্বীপের ৯৭ শতাংশ প্রবাল ধ্বংস হয়ে গেছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল আর প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও, এখন ১০ প্রজাতিও টিকে নেই।

সেন্টমার্টিনের তলদেশ ঘুরে আসে গবেষণা দল

সম্প্রতি গবেষণা দলের সঙ্গে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের তলদেশ ঘুরে আসেন সাংবাদিক ও লেখক মোহসীন-উল হাকিম। তিনি বলেন, মানুষ ছাড়া কোনও কিছু চিন্তা করা যায় না। কারণ সীমান্তবর্তী নির্জন জায়গাগুলোয় মানুষের চলাচল না থাকলে অপরাধীরা সুযোগ পাবে। আগে আমাদের গবেষণা করতে হবে প্রকৃতপক্ষে সেন্টমার্টিনের ধারণক্ষমতা কতো। সে অনুযায়ী দ্বীপটিতে পর্যটনসেবা গড়ে তুলতে হবে সরকারকে।

তিনি আরও বলেন, ছেঁড়া দ্বীপের তলদেশ ঘুরে প্রবালের ওপর ধুলার আস্তরণ দেখা গেছে। প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে কিছু পলিথিন-প্লাস্টিকের টুকরা পড়ে থাকতে দেখেছি। বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া জাল পড়ে আছে প্রবালের ওপর। কিছু জায়গায় প্রবালের কিছু অংশ কাটাছেঁড়া। পর্যটকদের কাছে বিক্রির জন্য স্থানীয়রা এই অপকর্ম করছে। এভাবে চলতে থাকলে ছেঁড়া দ্বীপের প্রবালও নাই হয়ে যাবে।

পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক বলেন, আগের তুলনায় ছেঁড়া দ্বীপে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। কিন্তু দ্বীপে ভ্রমণে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য আরও বেশি বিনোদনের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।

ছেঁড়া দ্বীপে নৌযান-যানবাহান চলাচলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পর্যটকদের অবাধ চলাফেরা ও স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ছেঁড়া দ্বীপ। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য ও প্রবাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শুধু ছেঁড়া দ্বীপ নয়, সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা উচিত।

কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়েরনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গত বছরের ২৩ মে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হতে দেখিনি। বরং দিন দিন প্রবাল দ্বীপটি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকছে। বর্তমানে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় ছেঁড়া দ্বীপের সামুদ্রিক প্রবাল হুমকির মুখে রয়েছে। সরকারের উচিত প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন করা। অন্যথায় আগামী ২০ বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে দ্বীপটি।

প্রফেশনাল আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার শরীফ সারওয়ার বলেন, জাহাজ চলাচল বাড়ায় দ্বীপের জেটির আশপাশের কোরালে বালুর আস্তরণ পড়েছে। এ ছাড়া শত শত পর্যটক ছেঁড়া দ্বীপে ভ্রমণের কারণে কোরালগুলো আরও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব নৌযান ছেঁড়া দ্বীপে নোঙর করা হয়, সেগুলো নিচে থাকা কোরালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সেন্টমার্টিনের চারপাশে পানির গভীরতা কম, তাই হুমকিতে সামুদ্রিক প্রবাল

‘দ্বীপ রক্ষায় সরকারের কঠোর আইন বাস্তবায়ন করা খুব জরুরি’, এ দাবি করে ২০১২ সাল থেকে প্রবাল দ্বীপের তলদেশে কাজ করা ফটোগ্রাফার শরীফ সারওয়ার বলেন, আগের তুলনায় দ্বীপে প্রবাল কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি সেন্টমার্টিনের চারপাশে পানির গভীরতা খুবই কম। এর মধ্যেও ১০টি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করছে। এর প্রভাব পড়ছে দ্বীপে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যারা ছেঁড়া দ্বীপে নৌযান ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনে নিয়ে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর ছেঁড়া দ্বীপে নৌযান-যানবাহন চলাচলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক নুরুল আমিন বলেন, আমাদের অল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ করা কঠিন। তবু আমরা সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।