যেভাবে ভুয়া পাসপোর্ট করেছে এক রোহিঙ্গা

নরসিংদীতে প্রবাসীর পাসপোর্ট বিষয়ে সরেজমিন খোঁজরমজান মিয়া একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী। তবে সেখানে গেছেন অবৈধ উপায়ে বিনা পাসপোর্টে। সম্প্রতি বৈধ প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন তিনি। এজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ছবি জমা দেন বাংলাদেশি দূতাবাসে। সেখানে থেকে তাকে একটি স্লিপ দেওয়া হয়। স্লিপে লেখা তারিখে পাসপোর্ট তুলতে গিয়ে জানতে পারেন তার নামে আগেই একটি পাসপোর্ট করা হয়েছে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তারই এক সময়ের সহকর্মী রোহিঙ্গা সমীর খানই কাজটি করেছে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে বছরখানেক আগেও অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করতো কিছু আদম ব্যবসায়ী। রমজান এভাবেই সে দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু, একই প্রক্রিয়ায় সেখানে গেছে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গাও। মিয়ানমারের বাসিন্দা হলেও নাগরিকত্ব না থাকায় এসব রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড়ের চেষ্টায় থাকেন। সেখানে যাওয়া বাংলাদেশিদের মূলত টার্গেট করে তারা। রোহিঙ্গা সমীরের দ্বারা এমন ঘটনারই শিকার হয়েছেন রমজান মিয়া।   

রমজানের এনআইডিএ বিষয়ে রমজান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনাটি বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, তিন বছর আগে দেশে রিকশা চালাতেন তিনি। সেসময় কাজের আশায় জাহাজে চেপে মালয়েশিয়া যান। সেখানে যাওয়ার পর প্রতিবেশী জয়নাল আবেদীনের মালয়েশিয়া প্রবাসী আত্মীয় মোহাম্মদ আলী ওরফে মফিজ তাকে কাজ জুটিয়ে দেন। এসময় সমীর খান নামের এক রোহিঙ্গার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। একসঙ্গে তারা কাজও করেন। মফিজের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমীরের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। 

কিছুদিন কাজ করার পর মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে বৈধভাবে পাসপোর্ট করে দেওয়ার নাম করে তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি, জন্মসনদসহ ৪০ হাজার টাকা নেয় মফিজ। কিন্তু তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেলেও পাসপোর্ট পাননি তিনি।

মালয়েশিয়া প্রবাসী নরসিংদীর রমজান মিয়াতিনি বলেন, এক পর্যায়ে মফিজ আত্মগোপন করে এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি সম্প্রতি পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য তার প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে অনুরোধ করেন। ওই মালিকের সহযোগিতায় মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন তিনি। পরে হাইকমিশন থেকে দেওয়া স্লিপ নিয়ে পাসপোর্ট ইস্যুর দিন পাসপোর্ট আনতে যান। এসময় তাকে জানানো হয়,তার নাম ঠিকানা ব্যবহার করে অন্য একজন পাসপোর্ট করে নিয়েছেন। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, তার নামে পাসপোর্টটি তুলে নিয়েছেন তারই সাবেক সহকর্মী রোহিঙ্গা নাগরিক সমীর খান।

রমজানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা আসল ও নকল জমা-স্লিপে দেখা যায়, উভয় রশিদের মধ্যে সব তথ্যই মিলে যায়। রশিদে উল্লেখ করা হয়েছে, নাম: রমজান মিয়া, পিতা: আবু কালাম, মাতা: শেফালি বেগম, গ্রাম: নন্দলালপুর, নরসিংদী সদর। কিন্তু রোহিঙ্গা সমীরের স্লিপে দেখা যায়, গ্রামের নাম নন্দলালপুরের স্থলে লেখা আছে আমিরাবাজ।

রমজানের নামে পাসপোর্ট তুলেছে রোহিঙ্গা সমীররমজান ও তার পরিবারের সদস্যরা জানান, সমীর খান পাসপোর্ট তৈরি করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভুয়া নম্বর ব্যবহার করেছে। তার পাসপোর্টে থাকা এনআইডি নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই বলে জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে। দূতাবাসে জমা দেওয়া স্লিপ ও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী রমজানের এনআইডি নম্বর ১৯৮৫৬৮১৬০২৫০০০০১৬। কিন্তু রমজানের নাম ব্যবহার করে যে পাসপোর্ট আগে করা হয়েছে তাতে এনআইডি নম্বর লেখা রয়েছে ১৯৮৫৬৮১৬০২৫১০৩১৪৩। নরসিংদীর নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে এ এনআইডি নম্বরের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। নন্দলালপুর গ্রামে গিয়ে ইস্যুকৃত পাসপোর্টধারীর ছবি দেখালেও তা চিনতে পারেননি কেউ। তবে সেখানে দেওয়া ঠিকানা অনুসারে প্রবাসী রমজানকে চিনেছেন সবাই।

কাগজপত্রে গ্রামটির নাম নন্দলালপুর হলেও এটি আমিরাবাদ ও আমিরাবাজ নামে পরিচিত। 

রমজানের এনআইডিতে দেওয়া ঠিকানাএ ব্যাপারে নরসিংদীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক জেবুন্নাহার পারভীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি নরসিংদীতে নতুন এসেছি। যতটুকু জানতে পেরেছি পাসপোর্টটি কুয়ালালামপুর দূতাবাস থেকে করা হয়েছে। এর বেশি আমি কিছুই বলতে পারছি না। বিস্তারিত জানতে চাইলে মালয়েশিয়ার দূতাবাসে যোগাযোগ করেন।’

রমজান মিয়া এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা হলে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তদন্তও করেছে। কিন্তু তদন্তের পর কিভাবে একজনের ঠিকানায় অন্যজনের পাসপোর্ট হয়? তাও আবার ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করে? এসব জালিয়াতিতে মফিজ জড়িত থাকতে পারে।’ এছাড়াও পুলিশি গাফিলতি ছিল বলেও দাবি করেছেন তিনি।

রোহিঙ্গা সমীরের স্লিপরমজানের স্ত্রী মর্জিনা বেগম জানান, বাড়িতে এক পুলিশ সদস্য এসে নাম ঠিকানা যাচাই করেছেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন,এই পাসপোর্টের জন্য ঢাকায় গিয়ে কাজ করতে হলে ৫-১০ হাজার টাকা লাগবে। এরপর  ৫ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি এবং দু’টি কাগজে আমার মায়ের স্বাক্ষর নেন। পরে আমরা গরিব বলে ওই পুলিশ সদস্যকে ২ হাজার টাকা দেই।

রমজানের পাসপোর্টের তথ্যের জন্য পুলিশ সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন ও আশাব উদ্দিন ভুঁইয়া।

রমজানের স্লিপএ ব্যাপারে নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্টের জন্য পুলিশ যথাযথ তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়ে থাকে। প্রবাসী রমজানের ক্ষেত্রেও তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সেই রিপোর্ট দেওয়ার পর কার পাসপোর্ট কাকে দিলো না-দিলো সেটা পাসপোর্ট অধিদফতরের বিষয়।’