শীতলক্ষ্যার পাড়ে কাঁদছেন নিখোঁজদের স্বজনরা

শীতলক্ষ্যা নদীতে এমভি রূপসী-৯ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমএল আফসার উদ্দিন নামে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ১৫-২০ জন। উদ্ধারকৃত লাশের পাশে বসে স্বজনরা কাঁদছেন, কেউ আবার নিখোঁজ স্বজনের সন্ধান পেতে আহাজারি করছেন। চারদিকে শুধু কান্নার শব্দ। যখন নদীতে উদ্ধারকাজ চলছে তখন দুই পাড়ে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। 

কেউ কেউ রাত পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কখন স্বজনের মুখ দেখবে, মৃত নাকি জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবে, সেই প্রশ্ন স্বজনদের চোখেমুখে। তবে সময় যত বাড়ছে স্বজনদের আশার আলো তত কমছে।

রবিবার (২০ মার্চ) দুপুরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে মুন্সিগঞ্জগামী এমএল আফসার উদ্দিন নামে যাত্রীবাহী লঞ্চটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। 

এ ঘটনায় মৃত ও নিখোঁজদের স্বজনরা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ভিড় করেন। একটি একটি করে উদ্ধার হতে থাকে লাশ। বাড়তে থাকে সংখ্যা। একে একে ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়। বাকি নিখোঁজদের সন্ধানে অব্যাহত রয়েছে উদ্ধারকাজ। সময় যত যাচ্ছে স্বজনদের আহাজারি তত বাড়ছে।

ভাগনির জামাতা জয়নাল আবেদীনের লাশ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জহিরুল ইসলাম মুন্সি বলেন, ‘নিহত জয়নাল আমার ভাগনির জামাই। সে সকালে ড্রেজারের ব্যবসার টাকার সংগ্রহ করতে এসেছিল। পরে ফেরার পথে লঞ্চ ডুবে যায়। এখন আমার ভাগনির কি হবে!'

স্বজনদের আহাজারি

দেড় বছর বয়সী ছোট ভাই সাফায়েত ও মা আরিফা বেগম নিখোঁজের খবরে বিলাপ করতে করতে কাঁদছেন বোন মাহি আক্তার। তিনি বিলাপ করেন, ‘ও ভাইরে, আমার ভাই কই, আল্লাহ গো আমার ভাই কই? আমার মা, আমার ভাই কই।'

ভাতিজি মাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন ডালিয়া বেগম। ভাতিজিকে সান্ত্বনা দিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। এ সময় ডালিয়া বলেন, বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ডাক্তার দেখাতে নারায়ণগঞ্জে যায় আমার ভাবি আরিফা ও ভাতিজা সাফায়েত। বাড়ি ফেরার পথে তাদের লঞ্চ ডুবে যায়। আমার বাবা আব্দুর রব কোনোমতে তীরে উঠতে পেরেছেন। ভাবি ও ভাতিজা নিখোঁজ। শেষ পর্যন্ত তাদের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। তবে এখনও লাশ হস্তান্তর করেনি ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। আমাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের রমজান বেগ এলাকায়। 

সাফায়েতের বাবা দ্বীন ইসলাম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমারে বাবা কইবো কে? এমন কেউ নাই যে, আমার ছেলেরে আদর করে নাই। আল্লাহ আমার ছেলেরে ফিরাইয়া দাও।'

স্ত্রীর সন্ধান না পেয়ে রাত পর্যন্ত নদীর তীরে বসে বসে কাঁদছেন আবু তাহের। বাসায় ফিরে সন্তানদের কি জবাব দেবেন, তাই নদীর তীরে বসে আছেন।

নিখোঁজ স্ত্রী উম্মে খায়রুন ফাতেমার সন্ধানে পাগলপ্রায় স্বামী আবু তাহের। তিনি জানান, তার স্ত্রী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বৈদ্যরবাজার হারিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ট্রেনিংয়ের জন্য মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে লঞ্চডুবির খবরে তিনি ছুটে আসেন স্ত্রীর সন্ধানে। এখন পর্যন্ত স্ত্রীর সন্ধান পাননি।

শুধু আবু তাহের মিয়া নন, এভাবে আরও অনেকে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে ভিড় করেছেন নদীর তীরে। রাত হলেও বাসায় ফেরেননি তারা। খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন, আর চোখের জল ফেলছেন।

লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন জন নারী, দুই জন শিশু ও একজন পুরুষ। উদ্ধার লাশের মধ্যে তিন জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন মুন্সীগঞ্জের ইসলামপুর এলাকার মৃত জুলফিকার আলীর ছেলে জয়নাল আবেদীন (৫৫), মুন্সীগঞ্জের দিন ইসলামের স্ত্রী আরিফা বেগম (৩৫) ও তার ১৫ মাস বয়সী ছেলে সন্তান সাফায়েত। 

নারায়ণগঞ্জ নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মনির এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এখনও উদ্ধারকাজ শেষ হয়নি।

এদিকে, এ ঘটনায় জলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।