মরে যাচ্ছে আড়িয়াল খাঁ

পাঁচ কিলোমিটার জায়গায় পাঁচটি বাঁধ আড়িয়াল খাঁ নদের বুকের ওপর। সেই বাঁধগুলো দিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। সড়ক দিয়ে চলছে যানবাহন। দুটি বড় বাঁধ বর্তমানে ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। নদে বাঁধ দেওয়ার ফলে দুই পাশে গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও স্থাপনা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দখল ও দূষণ। ফলে একসময়ের খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ এখন অস্তিত্ব সংকটে। এক নদে এত বাঁধ দেওয়ার ফলে মরা লাশে পরিণত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ, ভৈরব ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়িয়াল খাঁ নদ দিয়ে একসময় নৌ-পথে যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহন করা হতো। কিন্তু এখন এই নদে পানি নেই। নদের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা মরে গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলা সদরের থানার সামনে থেকে জালালপুর ইউনিয়নের ঝাকালিয়া পর্যন্ত একটি, কটিয়াদীর বীর নোয়াকান্দি-জালালপুরের চরনোয়াকান্দি বা খামখেয়ালির বাজারে দ্বিতীয়, কটিয়াদীর বরাদিয়া-জালালপুরের ফেকামারায় তৃতীয়, কটিয়াদীর চরিয়াকোণা-জালালপুরের ফেকামারায় চতুর্থ এবং লোহাজুরী-নাথের বাজারে পঞ্চম বাঁধ দেওয়া হয়েছে। প্রথম চারটি বাঁধ কটিয়াদী সদরের সঙ্গে জালালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে। শেষেরটি লোহাজুরীর দুটি অংশকে যুক্ত করেছে।

পাঁচ কিলোমিটার জায়গায় পাঁচটি বাঁধ আড়িয়াল খাঁ নদের বুকের ওপর

বেআইনিভাবে নির্মিত পাঁচটি বাঁধের মধ্যে সর্বশেষটি আংশিক অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

স্থানীয়রা জানান, আড়িয়াল খাঁ নদের বুকে প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হয় আশির দশকে। কটিয়াদী থানার সামনে থেকে এক কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা সড়কও হয়েছে। এর দুই পাশে এখন অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এই বাঁধের প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে জালালপুর অংশের খামখেয়ালি বাজার এলাকায় আরেকটি বাঁধ দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ বছর আগে। এটির ওপর ইট দিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এটাও এখন ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। এরপর একে একে আরও তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, উন্নয়নের নামে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাস্তবে বড় ধরনের কোনও উন্নয়ন হয়নি। অথচ নদ মরে গেছে।

এক নদে এত বাঁধ দেওয়ার ফলে মরা লাশে পরিণত হয়েছে আড়িয়াল খাঁ

বাঁধগুলোর কারণে নদের কোথাও সামান্য জলাধার, কোথাও কিছু জলাবদ্ধতা, কচুরিপানার জঞ্জালের চিহ্ন নিয়ে টিকে রয়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদের উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। সেখান থেকে একটি শাখা হয়ে কটিয়াদী সদরে মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুলিয়ারচর পর্যন্ত গেছে।

কটিয়াদী থানার সামনে নদের ওপর নির্মিত সড়কের পাশে চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন শিক্ষক জয়নাল আবেদীন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদের পানিপ্রবাহ ফেরাতে হবে। এতে যদি ওই সড়ক ও দোকানপাট সরাতে হয়, তাহলে তা-ই করা উচিত। চলাচলের জন্য সড়ক প্রয়োজন হলে সেতু করা যেতে পারে, বাঁধ নয়।

সর্বশেষ নির্মিত বাঁধের বিষয়ে কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান বলেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির চার লাখ টাকায় ব্যয়ে বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছি। এতে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে।

নদের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা মরে গেছে

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন, নদের পানিপ্রবাহ বন্ধ করে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি জানি। নদে বাঁধ দেওয়া বেআইনি। বাঁধ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্টরা পাউবোর মতামত নেননি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতিশ্বর পাল বলেন, এক থেকে দেড় বছর আগে নির্মিত সর্বশেষ বাঁধটি জেলা প্রশাসনের নির্দেশে অপসারণ করা হচ্ছে। আপাতত পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পুরনো বাঁধগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাছাড়া বাঁধগুলো অপসারণে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, নদে বাঁধ দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ইতোমধ্যে সর্বশেষ নির্মিত বাঁধটি গত ৮ মার্চ অপসারণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে এগুলো উচ্ছেদেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।