ওএমএসের চাল বিক্রি দেখিয়ে ‘কালোবাজারে ছাড়ছেন’ সালথার ২ ডিলার

ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় হতদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত খোলা বাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল বিতরণে ডিলারদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গত প্রায় তিন মাসে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় বরাদ্দের সিংহভাগ চাল খোলা ও কালোবাজারে বিক্রি করছেন তারা। এর ফলে চাল না পেয়ে প্রতিনিয়ত খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন কয়েকশ’ সুবিধাভোগী।

সালথা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে তিন মাসের জন্য দুই জন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন—হেমায়েত হোসেন ও পবিত্র কুমার মন্ডল। সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির জন্য তাদের নিয়মিত দুই মেট্রিক টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব চাল তারা ৩০ টাকা কেজি দরে প্রতিদিন পাঁচ কেজি করে চাল ৪০০ জন দরিদ্রের কাছে বিক্রি করবেন।

সালথা বাজারের ভাওয়াল রোডে ডিলার হেমায়েত হোসেনের চাল বিক্রয় কেন্দ্র এবং একই বাজারের পুরুরা রোড়ে পবিত্র কুমার মণ্ডলের চাল বিক্রয় কেন্দ্র। এই দুটি কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন উপজেলার ভাওয়াল, গট্টি, মাঝারদিয়া, সোনাপুর, রামকান্তুপুর, যদুনন্দী, বল্লভদী ও আটঘর ইউনিয়নের সুবিধাভোগীদের কাছে চাল বিক্রি করার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, দুই ডিলারই প্রতিদিন শুধু ভাওয়াল ইউনিয়নের ৮০ থেকে ১০০ জন হতদরিদ্রের কাছে চাল বিক্রি করে কেন্দ্র বন্ধ করে দেন। এরপর প্রথমে সরকার বরাদ্দকৃত বাকি সব চাল নকল টিপসই ও অন্যের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়ে ভুয়া তালিকা করে সব চাল বিক্রি দেখান ডিলাররা। পরে বেশি দামে এসব চাল খোলা ও কালোবাজারে বিক্রি করে দেন। গত পৌনে তিন মাস এভাবেই ওএমএসের চাল বিক্রি করে আসছেন দুই ডিলার। এদিকে হেমায়েত হোসেন সার ও টিবিসিরও ডিলার। প্রশ্ন উঠেছে, এক ব্যক্তি কীভাবে একাধিক ডিলারের দায়িত্ব পান।

গত রবিবার (২০ নভেম্বর) চাল বিক্রির ওই দুটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্র দুটিতে চাল বিক্রির সময় ডিলার বা ট্যাগ অফিসার নেই। তাদের অনুপস্থিতিতেই চাল বিক্রি করছেন ডিলারের লোকজন। কেন্দ্রের সামনে সুবিধাভোগীদের কোনও লাইনও নেই। দুই-একজন এসে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও টিপসই দিয়ে চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

ভাওয়াল পূর্বপাড়ার জুলিখা বেগম নামে এক নারীর কাছে একসঙ্গে ৩০ কেজি চাল বিক্রি করতে দেখা যায়। রবিবার বেলা ১১টার দিকে ভাওয়াল রোডের হেমায়েতের বিক্রয় কেন্দ্রে দুই নারী চাল কিনতে যান। তবে ‘কেন্দ্রে চাল নেই’ বলে তাদের জানানো হয়।

সালথায় ওএমএসের চাল ‘লুটপাট’, খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন সুবিধাভোগীরা

চাল না পাওয়া দুই নারী ভাওয়াল ইউনিয়নের কামদিয়া গ্রামের রহিমা বেগম ও হেনারা বেগম বলেন, ‘আমরা পাঁচ কেজি চাল কিনতে আসছিলাম। কিন্তু বেলা ১১টা বাজতেই তারা বলছে চাল শেষ। দেড় বছরের বাচ্চা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। চাল না পেয়ে ফিরে যেতে হবে।’

অপরদিকে পুরুরা রোডে পবিত্র কুমার মণ্ডলের বিক্রয় কেন্দ্রে চাল কিনতে আসা দুলাল কাজী বলেন, ‘আগেও আমি চাল কিনেছি, তবে তখন বিকাল ৫টা পর্যন্ত চাল দিতো। এখন তো দেখি ১২টার আগেই দোকান বন্ধ করে দেয়।’

উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের হতদরিদ্ররা অভিযোগ করে বলেন, যদুনন্দী, বল্লভদী, সোনাপুর, মাঝারদিয়া ও আটঘর ইউনিয়নের দরিদ্রদের সালথা বাজারে গিয়ে চাল কিনে আনা অসম্ভব। কারণ ৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সালথা বাজারে মাত্র পাঁচ কেজি চাল কিনতে গিয়ে যে টাকা ভাড়া বাবদ খরচ হবে, তাতে পোষাবে না। তাই ওএমএসের চাল কিনতে যান না তারা।

উপজেলার গট্টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লাবলু বলেন, ‘ওএমএসের চাল বিক্রির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার ইউনিয়ন থেকে কেউ এ চাল কিনতে যায় কি-না তাও বলতে পারবো না।’ 

আটঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল হাসান খান সোহাগ ও মাঝারদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আফছার উদ্দীনও একই কথা বলেন।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ডিলার হেমায়েত হোসেন বলেন, ‘মূলত পৌর এলাকায় ওএমএসের চাল বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু আমি তদবির করে ডিলার নিয়োগ পেয়েছি। উপজেলার যে কেউ আমার এখান থেকে ৩০ টাকা দরে পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারবেন। আমি চাল বিক্রিতে কোনও ধরনের অনিয়ম করিনি। নিয়মমতো চাল বিক্রি করছি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে আরেক ডিলার পবিত্র কুমার মণ্ডলের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সালথা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বুলেট বৈরাগী বলেন, ‘ডিলার যদি প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে হতো তাহলে জনগণের সুবিধা হতো। যেহেতু নীতিনির্ধারণ পর্যায় থেকে উপজেলায় দুই জন ডিলার নিয়োগ দিয়েছে, সেহেতু আমাদের কিছু করার নেই।’

ডিলারের বিরুদ্ধে কালোবাজার বা খোলা বাজারে চাল বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও এমন কোনও অভিযোগ পাইনি। আমাদের দুই জন তদারকি কর্মকর্তা সব সময় উপস্থিত থাকেন।’

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক ব্যক্তি পাঁচ কেজির বেশি চাল কিনতে পারবে না। আর এই চাল কালোবাজার বা খোলা বাজারে বিক্রির নিয়ম নেই। ডিলার ও ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে চাল বিক্রি করতে হবে। এসব নিয়ম যদি না নেমে চাল বিক্রি করা হয়ে থাকে, তাহলে প্রমাণ পেলে ডিলারদের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আকতার হোসেন শাহিন বলেন, ‘ওএমএসের চাল বিক্রিতে অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’