গুলিতে নিহত ‘সুলতান ভাই কাচ্চির’ ম্যানেজারের মেয়ে পেলেন জিপিএ-৫

‘জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর শোনার পর থেকে শুধু বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন। আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট বানানোর স্বপ্ন ছিল বাবার। সে পর্যন্ত দেখে যেতে পারলেন না। এটাই আফসোস, এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। ফল পাওয়ার পর বাবার স্বপ্ন আমার স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেছে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই। সেভাবে নিজেকে তৈরি করতে চাই।’

এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি জানালেন গুলিতে নিহত নারায়ণগঞ্জ শহরের ‘সুলতান ভাই কাচ্চি’ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার শফিউল আলম কাজলের বড় মেয়ে নুসরাত জাহান শ্রাবণ (১৮)। বাবার মৃত্যুর দুদিন পর বুধবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর পেলেন তিনি। ফল পাওয়ার পর থেকেই অনবরত কাঁদছেন নুসরাত।

বিকালে বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা মোল্লাবাড়ি এলাকার বাসায় নুসরাতের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় পরীক্ষার ফল ও বাবার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। পড়াশোনায় বাবার অবদান ও অনুপ্রেরণার কথা বলতে গিয়ে বারবার চোখের পানি মুছছিলেন।

কাজলের দুই মেয়ে ও স্ত্রী আসমা জামান

এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে নুসরাত বলেন, ‘বাবার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে পড়াশোনা করেছি। বাবার স্বপ্ন ছিল, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবো। পড়াশোনা শেষে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবো। বাবার স্বপ্নের পাশাপাশি আমার ইচ্ছে ছিল, বিদেশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার। বাবা বেঁচে থাকতেই আমার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলাম। তিনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই পর্যন্ত আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেননি। আমার সফলতা দেখে যেতে পারেননি, এটাই আফসোস, এটাই দুঃখ। তবে এখন আমার ইচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার। বাবার স্বপ্নই এখন আমার স্বপ্ন।’

বাবার আদর-স্নেহ আজ খুব মিস করছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম। আমাকে খুব আদর করতেন। রাতে ঘুমানোর আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। গত চার দিন ধরে বাবাকে খুব মিস করছি। খুব অসহায়ত্ব অনুভব করছি।’

হাজী আব্দুল মালেক হাইস্কুলের ব্যবসা বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ- ৪.৮ পেয়েছি জানিয়ে নুসরাত বলেন, ‘ওই পরীক্ষায় গণিতে নম্বর কম পাওয়ায় জিপিএ-৫ পাইনি। পরে বিভাগ পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করেছি। আজ ওই কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছি। বাবা বেঁচে থাকলে বাসায় দৌড়ে এসে বলতে পারতাম, বাবা তোমার মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তোমার স্বপ্নপূরণে ভালো ফল করেছি। কিন্তু তা হলো না।’

দুই মেয়ে ও স্ত্রী আসমা জামানকে নিয়ে বন্দরের কুশিয়ারা মোল্লাবাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন শফিউল আলম কাজল (৫০)। ছোট মেয়ে তাসনিয়া তারান্নুন ইকরা (১০) পঞ্চম শ্রণিতে পড়াশোনা করে।

তবে দুই মেয়ের পড়াশোনা চালানো নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কাজলের স্ত্রী আসমা জামান। স্বামীর উপার্জনের টাকায় সংসার ও মেয়েদের পড়াশোনা চলতো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সংসার কীভাবে চলবে, মেয়েদের পড়াশোনার খরচ কীভাবে চালাবো? জমানো কোনও অর্থ নেই, কোনও সম্পদ নেই। দুই মেয়েকে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো, সে দুশ্চিন্তায় আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গুলি করে তারা শুধু স্বামীকে মারেনি, এর সঙ্গে আমাদের তিন জনকে মেরে ফেলেছে। স্বামীকে ছাড়া কীভাবে চলবো আমরা? তিনি ছিলেন আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই বাড়িটি কাজলের চাচার। এতদিন কাজল ছিলেন তাই বাড়িতে থাকার জায়গা পেয়েছি। এখন তিনি নেই, সামনে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে দেবে কিনা জানা নেই।’

গত রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ‘সুলতান ভাই কাচ্চির’ ম্যানেজার শফিউল আলম কাজলকে গুলি করেন ওই রেস্তোরাঁর ভবন মালিক আজহার তালুকদার। ঘটনার রাতেই আজহার তালুকদার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারকে আটক করে পুলিশ। পরে রেস্তোরাঁর মালিক শুক্কুর আলী বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় আজহার তালুকদার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারকে গ্রেফতার দেখনো হয়।

এরই মধ্যে সোমবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাজল মারা যান। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেফতার আজহার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন বিকালে চাষাঢ়ার আঙ্গুরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে কাজলের লাশ রেখে বিক্ষোভ করেন স্বজন ও সহকর্মীরা।

রেস্তোরাঁর ম্যানেজার শফিউল আলম কাজল

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজহার তালুকদার ও তার ভাই আজিজুল হকের যৌথ মালিকানাধীন আঙ্গুরা শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলা ও দোতলার একাংশ ভাড়া নিয়ে ‘সুলতান ভাই কাচ্চি’ রেস্তোরাঁ দিয়েছেন শুক্কুর আলী। গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ ও পানির বিল নিয়ে আজহারের সঙ্গে শুক্কুর আলীর বিরোধ চলছিল। বিল নিয়ে গত রবিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রেস্তোরাঁর ম্যানেজার কাজলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় আজহারের। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন আজহার। এতে কাজল গুলিবিদ্ধ হন। সেইসঙ্গে আরও দুজন আহত হন। কাজলকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাজলের মৃত্যু হয়। নিহত কাজল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নের শাহ আলমের ছেলে।

কাজলের সঙ্গে আজহারের কোনও বিরোধ ছিল না উল্লেখ করে সুলতান ভাই কাচ্চি রেস্তোরাঁ মালিক শুক্কুর আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনার রাতে আমার কাছে বিদ্যুৎ ও পানির বিল ১০ লাখ টাকা দাবি করেছেন আজহার। টাকা দিতে অস্বীকার করলে দুর্ব্যবহার ও লাঞ্ছিত করেন। এ নিয়ে হাতাহাতি হয়। এ সময় গালিগালাজ করতে করতে বাসায় গিয়ে পিস্তল এনে গুলি ছুড়লে আমি দোকানের পেছনে পালিয়ে যাই। আমাকে না পেয়ে কাজলকে গালিগালাজ করেন। কাজল তাকে থামানোর চেষ্টা করলে দুটি গুলি করেন। মেডিক্যালে ময়নাতদন্তের সময় তার শরীর থেকে দুটি গুলি বের করা হয়েছে।’