অসময়ে ভাঙছে পদ্মার পাড়, আতঙ্কে বাসিন্দারা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট এলাকাসহ পদ্মা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে অসময়ে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে পদ্মা পাড়ের বাসিন্দাদের মাঝে ফের ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দৌলতদিয়া ঘাট আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় নদী শাসন সম্পন্ন হলে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ দৌলতদিয়া ফেরিঘাটসহ গোটা গোয়ালন্দ উপজেলা এলাকা নদীভাঙনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে বলে আশাবাদী স্থানীয়রা।

জানা যায়, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। প্রতিদিন সেখানে কয়েক হাজার বিভিন্ন গাড়ি ফেরি পারাপার হয়। পাশাপাশি লঞ্চে পারাপার হয় হাজার হাজার যাত্রী। এদিকে দৌলতদিয়া ঘাট নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকা। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সেখানে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের কবলে পড়ে পদ্মায় বিলীন হয় বিভিন্ন ফেরিঘাটসহ আশপাশের গ্রামের বহু মানুষের ঘরবাড়ি।

এদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নদীবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় দৌলতদিয়া প্রান্তে নদীর তীর রক্ষায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করার কথা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রকল্পটির নকশা এরই মধ্যে চূড়ান্ত করে তা অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ এখনও শেষ হয়নি।

সরেজমিনে ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের ২০০ মিটার উজানে অবস্থিত নতুনপাড়া গ্রাম এলাকায় নদীর তীর ভাঙন চলছে। সেখানে ভাঙন পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন গ্রামবাসীদের অনেকেই। দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট থেকে দেবগ্রাম অন্তারমোড় এলাকার বাহির চর দৌলতদিয়া, মজিদ শেখের পাড়া, সিদ্দিক কাজীপাড়া, ছাত্তার মেম্বারপাড়া, নতুন পাড়া, লালু মণ্ডলপাড়া, হাতেম মণ্ডলপাড়া, ১ নম্বর ব্যাপারীপাড়া, সাহা ব্যাপারীপাড়া, ঢল্লাপাড়া, আফছার শেখপাড়া, সাহাজদ্দিন ব্যাপারীপাড়া রয়েছে। নতুন পাড়া, ঢল্লাপাড়া, আফছার শেখপাড়া, ১ নম্বর ব্যাপারীপাড়া ও সাহাজদ্দিন ব্যাপারীপাড়ার অধিকাংশ বিলীন হয়েছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে লঞ্চঘাট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্থানীয় ও কৃষকদের দাবি, অধিক হারে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও বাল্কহেড নদীর কোলঘেঁষে চলার কারণে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। তাছাড়া শুকনো মৌসুমে ভাঙন রোধে নেওয়া হয়নি কোনও পদক্ষেপ। এভাবে ভাঙতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যে তাদের বসতবাড়িও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

কৃষক হারু শেখ বলেন, ‘আমার বাবা ও চাচাদের অনেক জমি ছিল। ভাঙতে ভাঙতে প্রায় সব জমি নদীতে চলে গেছে। কিছু জমি নদীর পাড় দিয়ে আছে। সেসব জমি কোনো রকম আবাদ করে সংসার চালাই। কিছুদিন ধরে নতুন করে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে যদি নদী ভাঙতে থাকে তাহলে আমার সবটুকু জমি নদীতে চলে যাবে। তখন ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করে খাবো? এক বছর আগের নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানে এসে কোনও রকম ঘরবাড়ি করে বসবাস করছিলাম। এখন আর থাকা সম্ভব হবে না। পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা আমরা। এখন কোথায় যাবো? আমাদের এখন একটাই চিন্তা যেভাবে ফসলি জমি ভাঙছে বসতবাড়ি আর রক্ষা পাবে না।’

এ সময় স্থানীয় হাফিজা বেগম জানান, ‘আমার ঘরের পাশে ভাঙন শুরু হইছে। গাঙে পানির বেগ বাড়লেই ভাঙন আরও বাড়বো। তহোন আর রক্ষা পামু না। আমরা গরিব মানুষ। ঘরবাড়ি গাঙে ভাঙলে যাওনের জায়গা নাই।’

ভাঙনকবলিত পদ্মার তীরে বসে বৃদ্ধ হোসেন আলি বলেন, ‘আমার অনেক জমিজমা ছিল। তিন বার ভাঙনে সবকিছু হারায় আমি এখন সর্বহারা। এই গ্রামে অন্যের জায়গায় ঠাঁই নিলাম। এখানেও (নতুনপাড়া) নদীতে ভাইংয়া যাইতাছে। এখানেও যদি নদীতে ভাইংয়া যায়, তাইলে আমারা আর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো, আমাদের দুঃখ বলার মতো জায়গা নাই।’

গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা মুন্সী মুঠোফোনে জানান, ‘নদী শাসনের জন্য বরাবরই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে ঘাট আধুনিকীকরণের জন্য জমি অধিকরণের কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যেই নদী শাসনের জন্য দৌলতদিয়া ফেরিঘাট আধুনিকীকরণ কাজ শুরু হবে।’

বিআইডাব্লিউটিএ-এর উপসহকারী প্রকৌশলী শাহ্ আলম জানান, বন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় নদীর তীর রক্ষায় দৌলতদিয়া প্রান্তে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী নদী শাসন করা হবে। এতে নদী ভাঙনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, লঞ্চঘাটসহ পাশের বিভিন্ন গ্রাম। প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হলেই ভাঙনরোধে স্থায়ী কাজ শুরু করা হবে।