সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে দস্যুদের তৎপরতা

সুন্দরবন

সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা আবারও বেড়েছে। দস্যুদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলে জেলেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও জেলেরা দল বেঁধে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।  র‌্যাব-৮ এর পরিচালক লে. কর্নেল আনোয়ার উজ জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সোমবার সকালেও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে এক বনদস্যু নিহত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুন্দরবন ও এর আশপাশের অঞ্চলে দস্যুদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ভেঙে যাওয়ার পর একাধিক ছোট ছোট বাহিনী আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সময় শরণখোলা রেঞ্জের শ্যালাগাং, হরিণটানা ও তাম্বুলবুনিয়ার সম্ভাব্য অঞ্চলে লিটন বাহিনী নামে একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের নৃশংসতা ও ডাকাতির কথা শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি এ ডাকাত দল পূর্ব সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন নদী থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ হত্যা করেছে বলে জানা যায়। পরে র‌্যাব-৮ এর গোয়েন্দা দল লিটন বাহিনীর সম্ভাব্য আস্তানা সনাক্ত করে সোমবার ভোর রাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের শৈলা খালে অভিযান চালায়। এসময় বন্দুকযুদ্ধে লিটন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড দস্যু মো. মুক্তার নিহত হয়। সে দাকোপ উপজেলার বাসিন্দা।

তিনি আরও জানান,সম্প্রতি সুন্দরবনের ‘মোস্তফা’ ওরফে ‘মাছ মামুন’ বাহিনী নামে নতুন দস্যু বাহিনী আত্মপ্রকাশ করেছে। ছয়-সাতজনের ওই দল নিজেদের ক্ষমতা জানান দিতে তাম্বুলবুনিয়া, বগারখাল, হরিণটানা খাল, ট্যাংরাখালীর খাল, ছাপরাখালীর খাল, বন্দে আলী খাল, পশুর, ভদ্রা এবং শিবসা নদী সংলগ্ন বিভিন্ন খাল ও চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়ার খালসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ জেলেদের অপহরণসহ মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালায়। দস্যুরা মোবাইলের মাধ্যমে জেলে মহাজনদের কাছে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করার পাশাপাশি তাদের বিষয়ে কারো কাছে কোনও তথ্য দিলে চরম মূল্য দিতে হবে বলে হুশিয়ার করে।  

তিনি আরও বলেন, এছাড়াও তারা সুন্দরবনের শিবসা,ভদ্রা,শ্যালাগাং এবং নদী সংলগ্ন বিভিন্ন খাল, চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়ার খালসহ বিভিন্ন এলাকায় অপহরণ ও লুটপাট চালায়। জেলেদের পরিবারের কাছ থেকে জন প্রতি বিপুল অংকের মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এসব সংবাদের ভিত্তিতে ১৫ অক্টোবর জোংড়ার খালের কাছাকাছি এলাকা থেকে দুই দস্যুকে আটক করা হয়। তারা মোস্তফা ওরফে মাছ মামুন বাহিনীর সক্রিয় সদস্য। আটক দুই দস্যু হচ্ছে রামপালের মো. রিপন সরদার ওরফে দুধ রিপন (৩৫) ও শ্যামনগরের মো. আবু সাঈদ গাজী (৩২)।

জেলেরা জানিয়েছে, দস্যু বাহিনীর সদস্যের কাছে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র  দেখতে পেয়েছে। সম্প্রতি কয়রার জাহিদ নামে এক জেলে লুকিয়ে কাঁকড়া ধরতে বনে যায়। দস্যুরা তাকে আটকে বেদম মারধর করে। যন্ত্রণা সয্য করতে না পেরে তিনি নৌকা থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ে। পরে তার সহযোগিরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় নদী থেকে তুলে আনে। 

সুন্দরবনের মাছ ব্যবসায়ি আবুল কালাম সানা, নুর হোসেন, সাঈদ আলী ও মুছা জানিয়েছেন, দস্যুরা বনের ভেতরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া জেলেদের কাছ থেকে গোন চুক্তিতে টাকা দাবি করছে। এ কারণে ৪নং কয়রা, ৫নং কয়রা, ৬নং কয়রা, পাথরখালি, জোড়শিং এলাকার শতাধিক জেলে সুন্দরবনে যাওয়া নিয়ে ভয়ে আছে।

দস্যুদের হাত থেকে পালিয়ে আসা কয়রার জেলে সাহেব আলী গাজী জানান, চালের দাম চড়া, বনে মাছ ধরে কোনও মতে সংসার চলে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে লুকিয়ে বনে গেলেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু দস্যুদের দাবিকৃত অর্থ না দিতে পারলে রেহাই নেই। কষ্ট নিয়ে বন থেকে ফেরার পর আর যেতে সাহস হচ্ছে না। এদিকে সংসারও চলে না।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক বলেন, ‘নতুন দস্যু গ্রুপ দাকোপ এলাকা দিয়ে শিবসা নদী হয়ে সুন্দরবনে ঢুকে চাঁদাবাজি করছে বলে শুনেছি। পুলিশ দস্যুদের ব্যাপারে তৎপর রয়েছে।’ 

কোস্টগার্ড পশ্চিম মংলা জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. হায়াত বলেন, ‘দস্যুদের ধরতে সুন্দরবনে অভিযান অব্যহত রয়েছে। নলিয়ান, আংটিহারা, দোবেকি, কাগা দোবেকি কনটিনজেন্ট অফিসের দায়িত্বশীলদের দস্যু দমনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ 

র‌্যাব-৮ এর তথ্য মতে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ১২টি বাহিনীর ১৩২ জন দস্যু, ২৪৯টি অস্ত্র ও ১২,৫৯২ রাউন্ড গোলাবারুদ’সহ আত্মমর্পণ করে। বাহিনীগুলো হচ্ছে, মাস্টার, মজনু, ইলিয়াস, শান্ত, আলম, সাগর, খোকাবাবু, আলিফ ও কবিরাজ বাহিনী। 

আরও পড়তে পারেন: রোহিঙ্গা সংকট বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়: আইওএম প্রধান